‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ এই দাবিটি ১৯৭৩ সালে উত্থাপন করেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক নির্মল সেন। সেই সময়ের ভয়াবহ চিত্রের কথা তাঁর এই বাক্যটি দ্বারাই কিছুটা অনুভব করা যায়। প্রায় ৪০ বছর পরে এসে আজও বাংলাদেশে ভয়াবহ সেই চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। চারদিকে চলছে গুম-খুন আর অপহরণের মহোৎসব। আপনি-আমি কে কখন কোথায় থেকে গুম-খুনের শিকার হয়ে যাবো এর কোনো গ্যারান্টি নেই। হয়ত আমার-আপনার স্বজনরা সৌভাগ্যবান হলে লাশ পেয়ে সান্ত¦না পাবে; আর হতভাগা হলে সেই সুযোগটুকুও তারা পাবে না। যেমন পায়নি ইলিয়াস আলী-চৌধুরী আলমসহ অসংখ্য মানুষের স্বজনরা। আপনি যে কেউই হোন না কেন ঘর থেকে বেরিয়ে যে নিরাপদে পুনরায় ঘরে ফিরবেন
এর ন্যূনতম গ্যারান্টিটুকুও আজ বাংলাদেশে নেই। চারদিকে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অরাজকতা ও অনাচারের ভয়াবহ চিত্র প্রতিদিনই আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি গণমাধ্যমের কল্যাণে। কিন্তু এর পরিণতি কী; কোথায় যাচ্ছে দেশ তা নিয়ে কারো মধ্যে যেন নেই কোনো ভাবনা। এ বিষয়ে যাদের উদ্বিগ্ন ও ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কথা তাদের যেন কিছুই হয়নি। দিব্যি আরামেই কাটছে তাদের দিনকাল। জনগণের প্রতি একটি সরকার বা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা না থাকলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
গত এক-দেড় বছর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভয়াবহ ঝড় বইয়ে গেছে। রাজনৈতিক ফায়দা লুটার ঘৃণ্য মহড়ায় কত প্রাণ যে বিনাশ হয়েছে এর সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার যে নির্লজ্জ উন্মাদনা আমরা এই সময়ে দেখেছি তাতে জাতি হিসেবে আমাদের মাথা লজ্জায় হেট হয়ে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ জাতির কপালে এমন নেতৃত্ব জুটেছে যারা নিজেদের স্বার্থ আর অভিলাস পূর্ণ করা ছাড়া আর কিছুই দেখে না। বরাবরই তাদের এই স্বার্থান্ধতা আর ক্ষমতার মদমত্ততার বলি হয়েছে সাধারণ মানুষ। নজিরবিহীন রাজনৈতিক ঝড়-ঝাপ্টার পর চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি নামমাত্র একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো রকম একটি সরকার ক্ষমতায় এসেছে। যেকোনো কারণেই হোক রাজনৈতিক অস্থিরতাও সাময়িকভাবে কেটে যায়। কিন্তু এ জাতির কপালে বুঝি স্বস্তি আর সয় না! গত কয়েক মাস ধরে সারা দেশে ভয়াবহ আকারে বেড়ে গেছে গুম-খুন আর অপহরণের ঘটনা। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় ওঠে আসছে ভয়াবহ চিত্র। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে প্যানেল মেয়র এবং একজন বিশিষ্ট আইনজীবীসহ ৭ জন লোক দিনেদুপুরে অপহৃত হওয়া এবং দুদিন পর শীতলক্ষ্যায় তাদের লাশ ভেসে ওঠার পর থেকে দেশবাসীর মনে গভীর আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এখানেই থেমে থাকেনি এসব ঘটনার ধারাবাহিকতা। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে অপহরণ আর খুনের নৃশংস ও রোমহর্ষক ঘটনা। এ অবস্থায় চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে ১৬ কোটি মানুষের।
ভয়াবহ চিত্র, উদ্বেগজনক খতিয়ান
আইন ও শালিস কেন্দ্র্র (আসক) এর প্রদত্ত তথ্য মতে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে মোট ২৬৮ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হয় ২৪ জনকে। পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় ১৪ জনকে। কিন্তু ১৮৭ জনের এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজই মেলেনি। সংস্থাটির দেয়া তথ্য মতে, ২০১৩ সালে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। ২০১৩ সালে ৭২ জন বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং এর মধ্যে ৫৩ জন গুম হয়; মাত্র পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
পুলিশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ শাখা বলছে, দেশের অপরাধ পরিস্থিতি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে অপহরণ বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। ২০১১ সালে দেশে অপহরণ ছিল ৭৯২ জন, ২০১২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৫০; আর ২০১৩ সালে হয়েছে ৮৭৯। ২০১৪ সালের তিন মাসেই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৯৬টি। গত তিন মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অপরাধের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রেই জানা যায়, জানুয়ারি মাসে দেশে ডাকাতির ঘটনা ঘটে ৭০টি, দস্যুতা ৯৯টি, খুন ৪০৩টি, দাঙ্গা ৯টি, নারী ও শিশু নির্যাতন ১১২৭টি, অপহরণ ৬২টি, পুলিশ আক্রান্তে ঘটনা ১০৪টি, চুরির ঘটনা ৬৩৩টি-সব মিলিয়ে সারা দেশে জানুয়ারি মাসেই মামলা হয় ১৩ হাজার ১৮৫টি। ফেব্রুয়ারি মাসে ডাকাতির ঘটনা ৪৮, খুন ৩২৮, দাঙ্গা ৪, নারী ও শিশু নির্যাতন ১ হাজার ১৪৬, অপহরণ ৫৫, পুলিশ আক্রান্ত ৪৮, চুরি ৬১৫- সব মিলিয়ে ১১ হাজার ৯৫৫। মার্চে ডাকাতি ৪৮, দস্যুতা ১০৫, খুন ৩৬১, দাঙ্গা ৬, নারী ও শিশু নির্যাতন ১ হাজার ৬৬৯, অপহরণ ৭৯, পুলিশ আক্রান্ত ৫৭, চুরি ৫৬৯-সব মিলিয়ে ১৪ হাজার ২২১। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও জনসংযোগ শাখা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত র্যা বের কাছে দুই হাজার ৬৪১ জনকে অপহরণের অভিযোগ আসে। এর মধ্যে এক হাজার ৮৭ জনকে র্যা ব উদ্ধার করে।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ বলছে, বাংলাদেশে গত চার মাসে ৮৭টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড- এবং ১৯ জনকে গুমের ঘটনা ঘটেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এসব মানুষদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরিবারগুলোর দাবি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই তাদের ধরে নিয়ে গেছে এবং এর পর থেকে তারা গুম হয়েছেন অথবা তাদের লাশ পাওয়া গেছে।
কালো পোশাকের ভয়াল মূর্তি
সারা দেশে আইনশৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতির মধ্যে নতুন আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এলিট ফোর্স র্যাব। সেনা, নৌ ও পুলিশ বাহিনী থেকে বাছাই করে চৌকস সদস্যদের নিয়ে ২০০৪ সালে তৎকালীন জোট সরকার গঠন করেছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব বাহিনী। সন্ত্রাস নির্মূলে এই বাহিনীটি অনেক ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে। তাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ র্যাব স্বাধীনতা পদকও পেয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকার সিঁড়ি হিসেবে যখন থেকে র্যা বকে ব্যবহার করা শুরু করে তখন থেকেই বিতর্কিত হতে থাকে এই বাহিনীটি। এর আগেও বিভিন্ন সময় র্যাবের বিরুদ্ধে ছোটখাট অভিযোগ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের উচ্চ পর্যায়ের তিন কর্মকর্তা সরাসরি যুক্ত থাকার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর এই বাহিনীর সুনাম সব ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, একে একে বেরিয়ে আসছে তাদের অনেক অপকর্মের কথা। এতদিন মূর্তিমান আতঙ্ক র্যাবের ভয়ে যারা মুখ খুলতে সাহস পাননি তারা নতুন করে অভিযোগের তীর তাদের দিকে ছুড়ছে।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় র্যাবের যে তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরাসরি সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ ওঠেছে তাদের একজন বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর জামাতা। শ্বশুরের আস্কারায় ওই র্যাব কর্মকর্তা অনেক অন্যায়-অপকর্ম করেছেন বলে এখন একে একে বেরিয়ে আসছে। ভয়াল কালো পোশাকের নিচে কুৎসিত যে চিত্র তা পুরোটাই ফাঁস হয়ে গেছে জনগণের সামনে। এখন বিরোধী দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে এই বাহিনী বিলুপ্তির দাবি উঠছে। যে বিএনপি সরকার র্যাব গঠন করেছিল তারাই এখন র্যাব বিলুপ্তির জন্য সবচেয়ে বেশি সরব। তাদের বক্তব্য হলো, যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাত জনগণের রক্তে রঞ্জিত সে বাহিনীর কোনো প্রয়োজন নেই। তবে সরকার এই দাবিকে হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। তাদের বক্তব্য হলো, একটি বাহিনীর কিছু সদস্য অনৈতিক কাজে জড়িয়ে গেলে পুরো বাহিনী বিলুপ্ত করার দাবি যৌক্তিক নয়। আওয়ামী লীগের নেতারা জোর গলায় চাপা পেটাচ্ছেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশের কিছু সদস্যও অনৈতিক কাজে জড়িত। তাহলে কি এই দুই বাহিনীও বিলুপ্তির দাবি করবে বিরোধী দল? তাদের যুক্তি সুন্দর, মাথায় ব্যথা থাকলে মাথা কেটে ফেলে দেয়া সমাধান নয়। তবে তাদের এটাও মনে রাখা দরকার, শরীরের কোনো অঙ্গে পচন ধরলে তা কেটে ফেলে দিয়েই পুরো শরীর রক্ষা করতে হয়। আর সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে র্যা বের তুলনা চলে না। কারণ সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক; আর পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিবেদিত। উভয়টিই একটি দেশের স্থায়ী বাহিনী। কিন্তু র্যাব কোনো স্বতন্ত্র বা স্থায়ী বাহিনী নয়। বিশেষ প্রয়োজনে এই বাহিনী গঠন করা হয়েছিল; এখন প্রয়োজন অনুভব না করলে বা এর দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা করলে তা বিলুপ্তি করতে আপত্তি কোথায়?
নির্বিকার সরকার
সারা দেশে গুম-খুনের এই মহোৎসব সরকারের মধ্যে যে কোনো ভাবনার উদ্রেক ঘটিয়েছে তা বলা যাবে না। জনগণের টাকায় লালিত-পালিত যে বাহিনীর দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা দেয়া তারাই আজ মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। অথচ সরকার তাদের পক্ষেই সাফাই গাইছে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় র্যা বের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকার পরও সরকার প্রথমেই কোনো অ্যাকশনে যায়নি; হাইকোর্টের নির্দেশের পর অনেক গড়িমসি করে সাবেক তিন র্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু তাদেরকে সরাসরি হত্যা মামলায় না জড়িয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এমনও হতে পারে জনগণের দৃষ্টি সে দিক থেকে ফিরে যাওয়ার পর সরকার তাদেরকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। কারণ সরকার তো তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। যে সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার নৈতিক কোনো ভিত্তি নেই সেই সরকার ক্ষমতায় দাপটের সঙ্গে টিকে আছে এই বাহিনীর কারণেই। বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বেপরোয়া চড়াও হয়ে র্যা ব-পুলিশ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে। সুতরাং সরকারের কাছে এই বাহিনীর সাতখুন মাফ যে হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের দেশে সব সরকারই কমবেশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। তবে বর্তমান সরকার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। নিয়মতান্ত্রিক মিটিং-মিছিলে কোনো উস্কানি ছাড়াই নির্বিচারে গুলি চালানোর ন্যাক্কারজনক উদাহরণ এই সরকার স্থাপন করেছে। পেটোয়া বাহিনী র্যা ব-পুলিশ; কখনো কখনো বিজিবি-সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় মাঠে নামিয়েছে আওয়ামী লীগ। থানায় থানায় একটি বিশেষ জেলার লোক বসিয়ে পুরো রাজধানীতে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে তারা। এজন্য এসব বাহিনী যখন অন্যায়-অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে সরকারের নৈতিক মনোবল নেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। নিজেরা নীতি-নৈতিকতা ও চরিত্রহীন হলে অন্যের অন্যায়-অপকর্মের বিচার কেউ করতে পারে না।
এ জাতির কপালে বরাবরই অত্যন্ত নির্লজ্জ, ব্যক্তিত্বহীন ও নীচু মানসিকতার সরকার জুটেছে। কেউ বেশি করেছে, কেউ কম। দিন দিন অতীতের রেকর্ড শুধুই ভঙ্গই হচ্ছে। অথচ বাইরের রাষ্ট্রগুলোর চিত্র যখন আমরা দেখি ভাবতেই ভালো লাগে। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি ফেরি দুর্ঘটনায় কয়েকশ ছাত্র-ছাত্রী মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পরপরই সে দেশের প্রধানমন্ত্রী পুরো দায় নিজের কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করেছে; রাষ্ট্রপতি কেঁদে কেঁদে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। শুধু তাই নয়, দায়িত্বে অবহেলার জন্য পুরো কোস্ট গার্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে। গত বছর লাটভিয়ায় একটি ভবন ধসে শ’খানেক লোক মারা যাওয়ার ঘটনায় সে দেশের প্রধানমন্ত্রী পুরো দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। আমাদের পাশের দেশ ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনার দায় নিয়ে মন্ত্রীর পদত্যাগের ঘটনা বারবার ঘটেছে। এই উদাহরণগুলো ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন শাসকের প্রমাণ বহন করে।
অথচ আমাদের দেশে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক মানুষ মারা যাওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ‘ঝাঁকুনি তত্ত্ব’ বের করেন। নিজের বেড-রুমে সাংবাদিক দম্পতি নির্মমভাবে খুন হওয়ার পরও দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলেন, ‘কারো বেড-রুমে নিরাপত্তা দেয়া আমাদের দায়িত্ব না।’ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় লঞ্চ ডুবে শত শত লোক মারা যাওয়ার পরও নৌমন্ত্রী সুন্দর স্যুট-কোট পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দাফন-কাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেয়ার ঘোষণাতেই শেষ করেন নিজের দায়িত্ব। আবার এই টাকা যেন দিতে না হয় সেজন্য পেট কেটে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার অভিযোগও ওঠে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। পিতার কোলে সন্তান সন্ত্রাসীদের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পরও যে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে পারেন, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন’ সে দেশের শাসকশ্রেণীর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র যে নেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
গুম-খুনের শেষ কোথায়?
চার দিকে চাপা আতঙ্ক; পুরো দেশই যেন গুম-খুনের মৃত্যুপুরী। কার জীবনে অথবা কার পরিবারে কবে নেমে আসবে দুর্ভাগ্যজনক ট্রাজেডি কেউ বলতে পারে না। যারা প্রিয়জন হারান কেবল তারাই বলতে পারবেন এর জ্বালা যে কত বিষের। একজন মানুষের গুম-খুন হওয়া মানে এর সঙ্গে জড়িত একটি পরিবার; একটি সমাজ। খুনের চেয়েও গুমের ভয়াবহতাটা আরো মারাত্মক। কারো প্রিয়জন যেভাবেই হোক মারা যাওয়ার পর তাকে নিজ হাতে দাফন-কাফন করতে পারলে মনে কিছুটা প্রশান্তি বোধ হয়। কিন্তু কেউ যদি জানেনই না তার প্রিয়জন বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তাহলে এর দুঃখ ও বেদনা যে কত কঠিন তা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। যাদের প্রিয়জন গুম হয়েছেন তাদের আকুতি একটাই অন্তত মৃতদেহটি যেন তারা পান; নিজ হাতে যেন দাফন-কাফন সারতে পারেন আপনজনের। আর বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রাণের দাবি হলো ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। সরকার যত নৈতিকতা ও চরিত্রহীনই হোক না কেন এর জন্য তাদেরকেই আন্তরিক হতে হবে। সরকার চাইলেই পারবে দেশের মানুষকে চলমান আতঙ্ক থেকে মুক্তি এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিতে।