৬ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলংকজনক দিন। ১৯৪৫ সালের এই দিনে জাপানের হিরোশিমা নগরীতে ঘটানো হয় এ যাবতকালের সবচেয়ে বর্বরতম ঘটনা। মানবসৃষ্ট দুর্যোগে এর চেয়ে ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা পৃথিবীতে আর ঘটেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ শিকার হয় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি নগরী। মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে এ দুটি নগরীতে পারমানবিক বোমার আঘাতে ঝরে যায় দুই লক্ষাধিক বনি আদমের প্রাণ। বোমার বিস্ফোরণের পর তাপমাত্রা বেড়ে চার হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে দাঁড়ায়। মানুষ ও আসবাবপত্রসমূহ মোমের মতো গলে যায়। গাছপালা ও তরুলতা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এর তেজসক্রিয়া সে সময়েই সীমাবদ্ধ
থাকেনি। পরবর্তী পাঁচ বছরে এ দুটি শহরে মারা গিয়েছিল দুই লাখ ৮০ হাজার মানুষ। এখনো পর্যন্ত সেখানে সবুজ গাছপালা জন্মায় না। পানি থাকে বিষাক্ত। নিষ্পাপ শিশুরা জন্মায় বিকলাঙ্গ হয়ে। বড় হয়ে আক্রান্ত হয় ক্যান্সারসহ নানা জটির রোগে। এই প্রতিক্রিয়া আরো কতদিন চলবে তা বলা যায় না সঠিকভাবে।
বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান আজ মানুষের জন্য বয়ে এনেছে অভাবিত সাফল্য। এক সময় মানুষ যা কল্পনা করেনি বর্তমানে বিজ্ঞান তা বাস্তবে পরিণত করেছে। পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিজ্ঞানের সফলতাকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে সুখী সমৃদ্ধ করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুসংখ্যক লোক বিজ্ঞানের এই সফলতাকে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তারা মেতে উঠেছে অস্ত্র প্রতিযোগিতার উম্মাদনায়। হিরোশিমা নাগাসাকির চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী আনবিক বোমা বর্তমানে বিভিন্ন দেশে রয়েছে। কেবল আমেরিকা ও রাশিয়ার হাতেই রয়েছে এক হাজারের মতো পারমানবিক বোমা। এগুলো সংরক্ষণ করতে গিয়েও ঘটেছে প্রাণহানি ও পরিবেশ বিপর্যয়। এ পর্যন্ত কম করে হলেও ২০টি দুর্ঘটনায় হাজারেরও বেশি মানুষ ও প্রাণী প্রাণ হারিয়েছে। অগণিত গাছপালা ধ্বংস হয়েছে।
শক্তির মদমত্তা ও অস্ত্রের এই উম্মাদনার ফলে সারা বিশ্ব আজ হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বের সিংহভাগ সম্পদ গুটিকতক দেশ ও ব্যক্তির কুক্ষিগত। সম্পদের অঢেল পাহাড় গড়ে তার অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে মানবসভ্যতাকে নিয়ে রীতিমত খেলায় মেতেছে। তারাই সারা বিশ্বের হর্তাকর্তা। এই বিশ্ব মোড়লদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সারা দুনিয়া। তাদের সম্পদের অধিকাংশই ব্যয় হয় অস্ত্র তৈরি খাতে। অথচ বিশ্বের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সারা বিশ্বের সাড়ে পাঁচশ কোটির মধ্যে ২৯২ কোটি মানুষ আজ দারিদ্র, অনাহার, অপুষ্টি এবং রোগ শোকে মুহ্যমান। ক্ষুধা ও অপুষ্টির কারণে তৃতীয় বিশ্বে প্রতিদিন ৪৫ হাজার শিশু মারা যাচ্ছে। ৯৫ শতাংশ লোক পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পরিপূর্ণভাবে মেটাতে পারছে না। অথচ একটি জঙ্গি বিমানের মূল্য দিয়ে ৪২ হাজার পল্লী চিকিৎসালয় স্থাপন করা যায়। একটি ট্যাংকের মূল্য দিয়ে ১০টি অত্যাধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যায়। পৃথিবীর মাত্র এক মাসের সামরিক ব্যয় দিয়ে সারা বিশ্ব থেকে অপুষ্টি, ক্ষুধা, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা দূর করা যায়।
সুতরাং এই চিত্র দেখে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, যতদিন অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলবে ততদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে শান্তি আসবে না। এই মুহূর্তে পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শান্তির ব্যবস্থা। আর সেই ব্যবস্থাপনা একমাত্র ইসলামেই রয়েছে। আল্লাহর দেয়া অপরূপ সুন্দর এই পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে বিশ্বকে নিয়ে যেতে হবে ইসলামের পথেই। যেকোনো ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টিকে ধ্বংস করা জঘন্যতম অপরাধ। কোরআনের ভাষায় ‘আর যখন সে বিমুখ হয় তখন চেষ্টা করে যাতে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে, ধ্বংস করতে পারে শস্যক্ষেত্র আর বংশধারা। আর আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা বাকারা-২০৫) অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আর যারা পৃথিবীতে অনর্থ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রচেষ্টা চালায়, আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।’ (আশ শুআরা-১৫২) আল্লাহ তাআলা সরাসরি আদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মানব গোষ্ঠী! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, শেষ দিবসের আশা রাখ এবং পৃথিবীতে অনর্থ বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সূরা আনকাবুত-৩৬)
মানুষের শান্তি বিঘিœত হতে পারে এ ধরনের কোনো কাজই ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা. এর অমর বাণী হলো ‘তোমাদের মাঝে সেই ব্যক্তি প্রকৃত মুসলিম যার হাত ও জিহ্বা থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ।’ যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে অস্ত্র ব্যবহার করে এবং প্রতারণা করে সে আমার দলভূক্ত নয়। বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে রাসূল সা. হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন, ‘হে লোক সকল! পরস্পরের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্র“র ওপর হস্তক্ষেপ হারাম করা হলো। পারমানবিক, রাসায়নিক পদার্থ সম্পর্কে ইসলামের নীতি হলো, যেসব বস্তু মানব জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদী ও স্থায়ী ক্ষতিকারক এবং উপকারের চেয়ে অপকারের আশঙ্কা বেশি ওইসব বস্তুর উদ্ভাবন, তৈরি ও ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। যেহেতু বর্তমান পারমানবিক প্রতিযোগিতা মানবসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, সেজন্য এ কর্মসূচি পরিহার করাই ইসলামের নির্দেশ। নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষার দোহ্ইা দিয়ে পারমানবিক শক্তির অধিকারী হয়ে অন্যদের জন্য হুমকি সৃষ্টি করা নীতি-নৈতিকতার বিচারেও সমর্থনযোগ্য নয়।
আজ যারা বিশ্ব শান্তির জন্য হাঁকডাক ও দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছে তারাই অশান্তির মূল হোতা-সে কথা বিশ্ববাসীর সামনে আর অস্পষ্ট নয়। মানবসভ্যতাকে হুমকি থেকে বাঁচাতে হলে প্রথমে তাদেরকেই সেই অসম প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসতে হবে। নিজেদের হাতে মানববিধ্বংসী অস্ত্র রেখে অন্যদেরকে নিরস্ত্রকরণের সবক দিলে তাদের অনৈতিক মোড়লীপনাই প্রকাশ পায়। সুতরাং তাদের মুখে এসব নীতিকথা মানায় না।
শান্ত নিবিড় পৃথিবী সবারই কাম্য। সবাই চায় শান্তিতে বসবাস করতে। কিন্তু শান্তিপ্রিয় মানুষদের এই প্রত্যাশা পূরণ হবে না যতদিন না দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে পৃথিবীর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষা পাবে। কিছু লোকের অপকর্মের কারণেই সারা বিশ্ব আজ মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। মানুষের নিজেদের আচরণের কারণেই আজ তারা হিরোশিমা ও নাকাসাকির মতো ট্রাজেডির শিকার। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘জলে ও স্থলে যাবতীয় বিপর্যয় মানুষের কৃতকর্মের ফসল। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা রুম-৪১)
এজন্য সম্ভাব্য বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে মানুষদেরকে সংশোধন হতে হবে। বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেদের কৃতকর্মের যাচাই করতে হবে। প্রকৃতি ও শান্তির ধর্ম ইসলাম মানুষদেরকে সেই পথেই হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ইসলামের সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সারা বিশ্বে ইসলামী আবহ সৃষ্টি করতে পারলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত শান্তির সন্ধান মিলতে পারে। তখনই অপরূপ সৌন্দর্যের এই বসুন্ধরা রক্ষা পাবে হিরোশিমা নাকাসাকির মতো মানব বিপর্যয় থেকে।