মহান স্রষ্টা প্রকৃতিকে সাজিয়েছেন নিপুণভাবে, করেছেন বৈচিত্র্য ও লাবণ্যময়। তাই আমাদের পরিপার্শ্ব নিয়ে গড়ে ওঠা প্রকৃতি হয়েছে সুষমামণ্ডিত ও সুরভিত। সব দেশের সব সময়ের প্রকৃতি এক নয়। স্থানভেদে ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকৃতির অবস্থাও হয় বিভিন্ন ধরনের। আমাদের সবুজ এই ভূখণ্ডের প্রকৃতি অপরূপ সুন্দর ও শোভিত। প্রকৃতির উপাদান এদেশের গাছ-পালা, মাটি-বায়ু, জল-ফুল-ফল, পশু-পাখি আর নদী-নালা খুবই বৈচিত্র্যময়। এ দেশের প্রকৃতিকে বলা হয় প্রকৃতির রাণী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন আমাদের প্রিয় দেশ। এর প্রকৃতি চিরকাল মানুষকে আকৃষ্ট করেছে, ভাবুক করেছে, করেছে মোহিত। কবিচিত্তে, শিল্পের তুলিতে কিংবা সাহিত্যিকদের কলমের ডগায় চিত্রিত হয়েছে এর রূপ ও মাধুর্যের কথা। তবুও এর পূর্ণাঙ্গ রূপ-যশ যেন রয়ে গেছে অব্যক্ত।
বাংলার প্রকৃতি ষড়ঋতুতে বিভক্ত। ঋতুচক্রে বর্ষার স্থান দ্বিতীয়। আষাঢ় ও শ্রাবণ-এ দু’মাস বর্ষাকাল। তবে এর ব্যাপ্তি আরো বিস্তৃত। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ আর প্রখর রোদের পর ঘন গৌরবে নব যৌবনে আসে বর্ষা। ষড়ঋতুর লীলার মাঝে বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যে বর্ষাকাল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বসন্তকে ঋতুরাজ বললেও রূপের গৌরব ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের জন্য বর্ষাই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। বর্ষার প্রকৃতিতে মহান স্রষ্টার অপরূপ সৌন্দর্যের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয়। নিখিল জাহানের স্রষ্টার অনিন্দ্য সুন্দর এই বসুন্ধরার যথার্থ রূপ কিছুটা টের পাওয়া যায়।
বর্ষা ঋতুতে নীল আকাশ সারাদিন আচ্ছন্ন থাকে কালো মেঘে। কখনো শুরু হয়ে যায় অঝোর ধারার রোদন। আল্লাহ তাআলা তার প্রকৃতির সেই মুহূর্তটির বর্ণনা দিয়েছেন কুরআনে- ‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন, অতঃপর তাকে পুঞ্জিভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন, অতঃপর তুমি দেখ যে, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি আচ্ছাদিত শিলাস্তুপ থেকে শিলাবর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎ ঝলক দৃষ্টিশক্তিকে যেন বিলীন করে দিতে চায়।’
প্রভুর বর্ষিত সেই বৃষ্টি প্রবাহিত হয় সবুজ চত্বরে। গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালি, তরুলতা তথা সমস্ত সৃষ্টিই এর দ্বারা সিক্ত হয়। সবুজ শ্যামল বসুন্ধরা আরো সজীব হয়ে উঠে। প্রবল বর্ষণের ফলে একদিন ভরপুর হয়ে উঠে খাল-বিল, নদী-নালা-জলাশয়। কখনো বৃষ্টির গর্জন আর কখনো রোদের ঝিলিক-এদুয়ের লুকোচুরি খেলায় বর্ষা ঋতু হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। বর্ষা প্রকৃতিকে নতুন সাজে সাজায়। প্রকৃতিতে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চালন ঘটে। বাগানে প্রস্ফুটিত কামিনী, রজনীগন্ধা, কদম, জুঁই, টগর, বেলি প্রভৃতি ফুলের মিষ্টি গন্ধ মন ভরিয়ে দেয়। সবুজের সমারোহে দৃশ্যমান হয়ে উঠে অপরূপ লাবণ্যতা। বর্ষার পূর্ণ যৌবনে টইটম্বুর জলরাশি ছুটে চলে সাবলীল গতিতে। দু’কূল ছাপিয়ে ছল ছল শব্দে এগিয়ে চলে নদী। বিভিন্ন রঙের পাল তুলে শত শত নৌকার ছুটোছুটি পল্লী-গাঁয়ের বুকে অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করে। পরিস্ফুট শাপলা-শালুক মোহনীয় ভঙ্গিমায় প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ধন করে চলে।
বর্ষার প্রকৃতিতে স্রষ্টার পরিচয় সহজেই ধরা দেয় সৃষ্টির কাছে। বর্ষা প্রকৃতিকে যেমন সতেজ ও গতিময় করে তোলে, তেমনি মানুষের মনকে করে তোলে সহজ, সরল ও ছন্দময়। সৃষ্টিশীল চেতনাকে করে সুচারু ও তীক্ষ্ম। একজন ভাবুকের জন্য স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবার উপযুক্ত সময় এটা। বর্ষার নির্মেদ প্রকৃতি ফুরফুরে অনুভূতি সৃষ্টি করে প্রতিটি অন্তরে। উচ্ছ্বাস ও ভাবাবেগে তাড়িত করে সকলকে। বর্ষার প্রকৃতি উদার, প্রেম ও ভালোবাসার সরল অনুভূতি জাগ্রত করে। আউশের সবুজ শীষের মিষ্টি হাওয়ায় প্রাণে যে দোলা লাগে তার নজীর সত্যিই বিরল! তাই বর্ষা স্রষ্টার অপূর্ব দান। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া শ্রেষ্ঠ ঋতু।
বর্ষা ঋতু আমাদের জন্য আসে আশির্বাদ হিসেবে। সারা বছরের পুঞ্জীভূত আবর্জনা বর্ষার বারিধারায় ধৌঁত হয়ে স্বচ্ছ নির্মল ও সুশোভিত হয়ে উঠে। সোনালি আঁশ আর আউশের রূপালী ধানে ভরে উঠে কৃষকের ঘোলা। আম, জাম, কাঠাল, আনারস প্রভৃতি রসালো ফলের সুস্বাদু স্বাদে তৃপ্ত হই আমরা। উৎপন্ন হয় নানা জাতের শাক-সবজির সম্ভার। বর্ষার ভরা নদী বহন করে আনে ঊর্বর পলি মাটি আর মজাদার মাছ। আমাদের প্রিয় এই দেশকে করে তুলে আরো বেশি সুজলা, সুফলা, শষ্য, শ্যামলা। আবার কখনো বর্ষার প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার কারণে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও সৃষ্টি হয়। তবে তা আমাদের বিচ্যুত জীবনধারাকে স্রষ্টার প্রতি নিবদ্ধ করার জন্যই হয়ে থাকে। দুর্যোগময় সেই মুহূর্তে সৃষ্টির প্রতি মমতা দেখিয়ে স্রষ্টার ভালোবাসা কুড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ থাকে। ‘মানুষ মানুষের জন্য’-এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দুর্যোগ কবলিত সৃষ্টিজীবের পাশে দাঁড়ালে স্রষ্টার কৃপার ছোঁয়া অবশ্যই লাগবে। সেই সুযোগে আমরা অর্জন করে নিতে পারি মহান প্রভুর উঞ্চ সান্নিধ্য। তাই বর্ষা সর্বাবস্থায় আমাদের জীবনের জন্য কল্যাণকর।
কুশলী স্রষ্টার প্রতিটি সৃষ্টিই শিল্পমানসম্পন্ন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। বাংলার বর্ষার অনিন্দ্য রূপও তার সেই নিখুঁত সৃষ্টির একটি। তিনি আমাদেরকে এই বিশেষ দানের মাধ্যমে তার কৃপার ডোরে আবদ্ধ করেছেন। আমাদের উচিত এর যথাযথ শোকর আদায় করা। তার প্রশংসাগীতি গাওয়া। আমাদের জীবনপ্রবাহকে তার নির্দেশনা অনুযায়ী তারই পথে প্রবাহিত করা।
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বর্ষা
Tags