১৬০ কোটি মুসলমানের অভিভাবক কে?

5lagsবিশ্বের কোথাও মুসলমানরা আজ তেমন ভালো নেই। সারা বিশ্বেই মুসলমানরা মার যাচ্ছে। কেউ মরছে আগ্রাসী শক্তির হাতে, কেউ স্বৈরশাসকদের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে মারা যাচ্ছে আরো বেশি মুসলমান। অনাহার, দারিদ্র্যের কারণেও অকালেই ঝরে যাচ্ছে বহু মুসলমানের জীবন। কিন্তু এসব দেখার কেউ নেই। এসব বন্ধে নেই কোনো যোগ্য নেতৃত্বও। বস্তুত বিশ্বের প্রায় ১৬০ কোটি মুসলমান আজ নেতৃত্বহীন। নেতা হয়ে যারা দেশ শাসন করছেন তাদের বেশিরভাগই স্বৈরাচার, অপদার্থ, দুর্নীতিবাজ ও পাশ্চাত্যের পদলেহী, সর্বোপরি মুসলমান নামধারী মাত্র। ইসলামী চেতনা বড়জোর তাদের প্রাসাদের দেয়ালের শোভা বর্ধন করে, নিজেদের জীবনধারায় মহান এই ধর্মের কোনো প্রতিফলন ও চর্চা নেই। বেশিরভাগ মুসলিম দেশের শাসকই জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছেন। তাদের পেছনে জনগণের কোনো ম্যান্ডেট নেই। মুসলিম বিশ্বের মুরব্বি সৌদি আরবের ক্ষেত্রে একথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য বাংলাদেশসহ বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রেই। মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রচর্চার অভাব বড়ই প্রকট। কোনো কোনো দেশে সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে এর কোনো রূপায়ন নেই। এই যখন মুসলিম বিশ্বের শাসকদের অবস্থা তখন তাদের জনগণের উন্নতির আশা করা বাতুলতা বৈকি। উন্নতি তো পরে, আগে দরকার বেঁচে থাকা। সেটাই এখন মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুসলমানদের জীবন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে কম দামি বস্তু। বিশ্বের সর্বত্র প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক মুসলমান যুদ্ধ, রাজনৈতিক সহিংসতাসহ নানা মানবসৃষ্ট কারণে মারা যায়। অথচ মুসলিম বিশ্ব নীরব। জনগণেরও এসব মৃত্যু গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। ফিলিস্তিনে ইহুদিদের হাতে মারা যাচ্ছেন অসহায় নারী-পুরুষ-শিশু। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মুসলমানদের রক্তস্রোত থামছেই না। ইরাকের মুসলমানরা মরে রাস্তায় পড়ে থাকছে। সিরিয়ায় হাজার হাজার মানুষ প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ক্ষমতার বলি হয়েছেন, হচ্ছেন। সুদান, মালি, নাইজেরিয়া, মিশর, লিবিয়ায় মুসলামদের জীবন যেন খেলনায় পরিণত হয়েছে। বসনিয়া ও চেচনিয়ায় মুসলমানদের অকাতরে জীবন দিতে হচ্ছে। অথচ এসব বন্ধে মুসলিম দেশগুলোর নেতারা নির্বিকার। গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার নিন্দা জানানোর সাহস দেখাতে পারেনি বেশিরভাগ মুসলিম প্রধান দেশের শাসকরা। এর প্রধান কারণ হলো বর্তমানে বেশিরভাগ মুসলিম শাসকদের হাতই তাদের জনগণের রক্তে রঞ্জিত। জনগণের কল্যাণসাধন তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের দিনরাত কাটে ক্ষমতা দখল ও ধরে রাখার ফন্দিফিকিরে।

মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ শাসকই জনগণের ওপর চেপে বসেছেন। কোনো কোনো দেশে নামবর্সস্ব গণতন্ত্র থাকলেও নির্বাচনের প্রতি অনাস্থা সংকটকে আরো গভীরতর করেছে। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম প্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়ায় সম্প্রতি তুলনামূলক একটি ভালো নির্বাচন হলেও ক্ষমতালিপ্সুদের জন্য তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি একটি বৈধ সরকারকে উৎখাতে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। মালদ্বীপে নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। বাংলাদেশে নির্বাচনকে তামাসায় পরিণত করা হয়েছে। মালয়েশিয়া, তিউনিশিয়া, ইরান, নাইজেরিয়ায় নির্বাচনীব্যবস্থা ও গণতন্ত্র নিয়ে সংকট আছে। অমুসলিম বিশ্বেও মুসলমানরা মার খাচ্ছে। চীনের জিনজিয়াং, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ, ফিলিপাইনের মিন্দানাও, মিয়ানমারের রাখাইন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবনে এখন ঘোর অন্ধকার।

অথচ মুসলমানদের জন্য কথা বলার মতো বলতে গেলে কেউ নেই। মুসলমানদের পবিত্রতম স্থান মক্কা ও মদিনা শাসনকারী সৌদি আরবের রাজতান্ত্রিক শাসকদের গদি এখন টলটলায়মান। বাদশাহ আব্দুল্লাহর ইন্তেকালের পর সালমান ক্ষমতায় বসেছেন। তিনিও বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আগে বিভিন্ন মুসলিম দেশের সংকটে মাঝে মাঝে সৌদি আরব ভূমিকা রাখতো। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবের ভূমিকা হতাশাজনক। নিজেদের বংশানুক্রমিক শাসনকে টিকিয়ে রাখতে মিশর ও ফিলিস্তিনের গণহত্যার পক্ষ নিয়েছেন সৌদি শাসকরা। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ একজন আধা স্বৈরশাসক হলেও মুসলিম বিশ্বের ইস্যুতে কথা বলতেন। তার দেশ এখন শাসন করছেন কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা একজন প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে মুসলমানদের পক্ষে কথা বলেন একমাত্র তুর্কি প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। কিন্তু এক এরদোগান দিয়েই তো আর অর্ধশত মুসলিম বিশ্বের সমস্যার সমাধান হবে না। দরকার আরও অর্ধশত এরদোগান। কিন্তু তেমন কোনো সম্ভাবনা বা সুযোগ নেই। অর্থব মুসলিম নেতাদের শাসন এতোটাই ভয়ঙ্কর যে কোনো এরদোগান তৈরি হতে দিতেও তারা প্রস্তুত নয়। মালয়েশিয়ার আনোয়ার ইব্রাহিম এর বড় প্রমাণ। বিচারের নামে ওই দেশের সরকার তার ওপর কী অবিচারটাই না করে চলেছে।

দুই
মুসলমানদের দুর্দিনে মুসলিম বিশ্বের সরকারপ্রধানদের ভূমিকা খুবই হতাশাজনক। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি গাজায় ইসরাইলি বর্বরতা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে তখনও নীরব ছিল মুসলিমপ্রধান দেশের শাসকেরা। বর্বর ইসরাইলের বিরুদ্ধে জোরালো মৌখিক প্রতিবাদটুকু তারা করেননি। মুসলমানদের সমস্যা ও সংকট নিয়ে শাসকদের তেমন কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তারা তাদের নিজেদের গদি রক্ষায় পুরোদস্তুর ব্যস্ত। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এমন কোনো কর্ম নেই যা মুসলিম শাসকরা করতে পারেন না। পশ্চিমা প্রভুদের খুশি রাখার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন তারা। আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক সম্পদ পশ্চিমাদের হাতে তুলে দিয়ে আরব বিশ্বের শাসকেরা দিব্যি আরাম-আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। বংশ পরম্পরায় বা অনৈতিকভাবে ক্ষমতায় আসা এসব শাসক সবসময় ক্ষমতা হারানোর ভয়ে থাকেন। দীর্ঘ সংগ্রামের পর নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় মিসরের শাসনক্ষমতায় আসা মুহাম্মদ মুরসি শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেননি নানা ষড়যন্ত্রের কারণে। মুরসিকে উৎখাতে বিশেষ সহায়তা দিয়েছেন আরব বিশ্বের সরকারপ্রধানেরা। ওই শাসকদের ব্যক্তিজীবন থেকে নিয়ে কোথাও ইসলাম ও মুসলিম আদর্শের কোনো বালাই নেই। মূলত মুসলমানদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতা ও নৈতিক অবস্থান বেশির ভাগ মুসলিম দেশের শাসকদেরই নেই।

মুসলিম দেশগুলোতে আজ একদিকে ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের অভাব, অন্যদিকে পশ্চিমা শাসকদের দয়া-দাক্ষিণ্যের আকাক্সক্ষা। এ দুটি ব্যাধিতে আক্রান্ত মুসলিম শাসকদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রে ন্যায় ও সাম্য আশা করাও ভুল। মুসলিম দেশগুলোতে আজ শাসনের নামে চলছে একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও স্বৈরাচারী তা-বলীলা। এ সুযোগ গ্রহণ করছে বাইরের শক্তিগুলো। তারা একের পর এক মুসলিম দেশকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে।  ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া সবখানেই পশ্চিমা থাবা বিস্তৃত। মিসর, লেবানন, তিউনিসিয়া, পাকিস্তানসহ মুসলিম দেশগুলোকে পরিকল্পিতভাবে তারা ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারা করছে। অথচ এগুলো নিয়ে কোনো ভাবনা নেই মুসলিম শাসকদের।

বিশ্বে ৪৫টি স্বাধীন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ রয়েছে। কয়েকটি দেশ ছাড়া বাকি সবকটি দেশে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা তাদের নেতৃত্ব বহাল রাখার জন্য বিদেশি সমর্থন অপরিহার্য মনে করেন। ফলে তাদের অধিকাংশই সা¤্রাজ্যবাদের পা-চাটা, দুর্নীতিগ্রস্ত, অযোগ্য, একই সঙ্গে স্বৈরাচারী। দেশের, জনগণের ও ধর্মের জন্য তাদের আদৌ কোনো দরদ ও প্রতিশ্রুতি আছে বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এজন্য সা¤্রাজ্যবাদকে মোকাবিলার কোনো চেষ্টা তাদের নেই। ইসলামী আদর্শের বিলুপ্তি ঘটলেও তাদের নেই কোনো মাথাব্যথা। ইচ্ছে করে পশ্চিমা নগ্ন সংস্কৃতি আমদানি করা হচ্ছে কোনো কোনো আরব দেশে। শাসকেরা চান, তাদের দেশের জনগণের নৈতিক অবস্থানটি দুর্বল হয়ে পড়–ক; সরকারের অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা না থাকুক। কারণ জনগণ যখন পশ্চিমা সংস্কৃতির মোহে বিভোর হয়ে যাবে তখন তাদের মধ্যে ঈমানি ও আদর্শিক স্পৃহার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। আর এটা না থাকলে কোনো শাসকের অপকর্মের প্রতিবাদ করার নৈতিক সাহস আর কারো থাকবে না। এতেই নিরাপত্তা বোধ করেন মুসলিম শাসকরা।

প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই চলছে রাজনৈতিক দৈন্যদশা। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যারা ইসলামকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলন করছেন তাদেরকে প্রতিটি মুসলিম দেশের সরকার শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে। আর পাশ্চাত্য সভ্যতার নেতারা তাদেরকে মৌলবাদী, জঙ্গি ও আলকায়েদার সদস্য বলে গালি দেয়। আর তাদের দমন করার জন্য মুসলিম নামধারী সরকারকে চাপ দেয়। মুসলিম দেশগুলোর সরকারপ্রধানরা সত্যিকার ইসলামের অনুসারী হলে পশ্চিমা শক্তিসহ সব ইসলাম বিদ্বেষী শক্তি মুসলিম দেশ ও তাদের প্রধানকে সমীহ করতো। ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলো বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতো। জাতিসংঘে তাদের অবস্থান থাকতো শক্তিশালী, তাদের একতা ভাবিয়ে তুলতো বিশ্ব পরাশক্তিগুলোকে।

আজকের মুসলমানদের দুর্দশার জন্য দায়ী মুসলিম নামধারী শাসকেরা। মুসলিম উম্মাহর আসল সংকট মুসলিমদের অনৈক্য। আর সংকটের মূল কারণ হলো মুসলিম জনগণকে সত্যিকার মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার অভাব। মুসলিম সরকার পরিচালকরা যদি মন-মগজ ও চরিত্রে মুসলিম হতেন তাহলে তারা উত্তরাধিকার সূত্রে যারা মুসলমানের সন্তান তাদেরকে খাঁটি মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব বোধ করতেন। তারা কখনো দৈনন্দিন জীবন, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি থেকে ধর্মকে উৎখাতের চিন্তা করতেন না। সত্যিকার মুসলিম হলে বা মুসলিম শাসক হলে তারা কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী তাদের কর্তব্য পালন করতে সচেষ্ট হতেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, সব দিক বিবেচনায় অনুসরণযোগ্য এবং যথার্থ অর্থে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো একজন শাসকও সারা বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

Related posts

*

*

Top