আজমিরের জ্যোতির প্লাবন

urlশরিয়তের আধ্যাত্মিক ধারাটি যে চারটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পূর্ণতা পেয়েছে চিশতিয়া এর অন্যতম। আমাদের দেশের অধিকাংশ পীর মাশায়েখই এই তরিকার অন্তর্ভুক্ত। সর্বাধিক প্রচলিত ও মাকবুল এই তরিকাটির প্রতিষ্ঠাতা আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রহ.। উপমহাদেশে ইসলাম আগমনের শক্তিশালী যে মাধ্যম পীর-আউলিয়া, খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতিকে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব

হিসেবে গণ্য করা যায়।

মধ্য এশিয়ার সিজিস্তানে জন্ম নেয়া এই সাধক ভারতবর্ষে আসেন ১১৯১ সালে। তখন তার বয়স ৫৬ বছর। গোটা ভারতবর্ষ সে সময় কুফর, শিরক ও মূর্তিপূজায় ছেয়ে গিয়েছিল। একত্ববাদের কথা বিস্মৃত হয়ে বহুত্ববাদকে মানুষ আঁকড়ে ধরেছিল। ইট-পাথর, বৃক্ষ-লতা, চন্দ্র-সূর্য সবই ছিল তাদের পূজার বস্তু। কুফরির এই জমাট অন্ধকারের ধাঁধায় পড়ে তারা ছিল উদভ্রান্ত। মুসলিম উম্মাহর সেই নাজুক পরিস্থিতিই খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতি রহ.-কে দিল্লিতে ছুটে আসতে বাধ্য করে।

গোটা ভারত উপমহাদেশের ইসলামের প্রচার প্রসারে তাঁর অবদান চির ভাস্বর। সুদূর আরবে প্রজ্জ্বলিত ইসলামের আলোকবিন্দুটি আরব-লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে হিমালয়ের পাদদেশে প্রৌজ্জ্বল জ্যোতি ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে তাঁর নামটি বিশেষভাবে উলে¬খযোগ্য। পথহারা মানুষদের আলোকদিশা দেয়া, মানবতার বিকাশ, আধ্যাত্মিকতার চর্চা ও চারিত্রিক উৎকর্ষের জন্য তিনি ইতিহাসের পাতায় অম্লান হয়ে আছেন।

খাজা সাইয়েদ মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ. এর জন্ম ১১৪১ সালে। পিতা গিয়াসুদ্দীন হাসান চিশতী এবং মাতা সায়্যেদা মাহে নূর উভয়েই ছিলেন আল্লাহওয়ালা। পারিবারিক ঐতিহ্যে বেড়ে ওঠা মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ. বাল্যকাল থেকেই ছিলেন বহুমুখী গুণের অধিকারী। প্রখর মেধা, নিরলস প্রচেষ্টা আর শিক্ষকদের সুদৃষ্টির কারণে অল্প বয়সেই তিনি পুঁথিগত বিদ্যার দ্বার অতিক্রম করেন। বাল্যকালেই তিনি মাতা-পিতার শীতল ছায়া থেকে বঞ্চিত হন। অল্পদিনের ব্যবধানে বাবা-মায়ের মৃত্যু এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিরূপ চিত্র তাঁকে অনেকটা ভাববাদী মানুষে রূপান্তর করে। তাঁর সমাজে বিরাজমান মানবতার লঙ্ঘন, পাশবিকতার স্ফূরণ এবং আত্মিক বিকারগ্রস্ততা তাঁকে সামাজিক জীবনাচরণ থেকে দূরে ঠেলে দেয়।

খাজা উসমান হারুনী রহ. এর কাছে দীক্ষা লাভ করে তিনি আধ্যাত্মিক জগতে অবগাহন করেন। আধ্যাত্মিক রাহবার ও মুর্শিদের ইঙ্গিতে খাজা  মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ. ১১৯১ সালে ৫৬ বছর বয়সে পাড়ি জমান ভারতবর্ষে। প্রথমে তিনি আজমিরে এসে অবস্থান করেন। সবেমাত্র মুসলিম শাসনের সূচনা। মুসলমানদের জন্য মুক্ত স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালন এবং প্রচার ও প্রসারের পরিবেশ তখনও ভালোভাবে তৈরি হয়নি। এজন্য প্রথমে তাঁকে অবতীর্ণ হতে হয় নানান প্রতিকূলতার। বর্ণ হিন্দুরা তাঁর সামনে আবির্ভূত হয় বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে। কুতুবুদ্দীন আইবেক, মুহাম্মদ ঘোরী প্রমুখ মুসলিম শাসকের সহযোগিতা এ সময় তাঁকে বিশেষভাবে প্রেরণা যোগায়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা সামাল দেয়ার পর তিনি আত্মনিয়োগ করেন দ্বীন প্রচারে। হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে তাঁর প্রচেষ্টায় ইসলামকে একটি বিজয়ী শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হন তিনি। দিল্লিতে তাঁর হাতে বহু অমুসলিম ইসলামের সুধা পান করেন। আজমির থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘চিশতিয়া’ তরিকার। ভারতবর্ষে সর্বাধিক ব্যাপৃত ও বহুল প্রচলিত তরিকা এটাই।

খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ. প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে দূরে থেকে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিপ¬বের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর দর্শন ছিল ধর্মকে মানব সেবার পরিপ্রেক্ষিতে উপস্থাপন করা। এজন্য তাঁর কাছে ইবাদতের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ‘দুঃখীর দুঃখ দূর করা, অসহায়ের অভাব মোচন করা এবং ক্ষুধার্তকে আহার করানো।’ মানবাত্মার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনে তাঁর প্রচেষ্টা ছিল নিরন্তন। অন্তরে পুঞ্জিভূত কলুষতা দূর করে নূরের পরশ বিছিয়ে আত্মার জগৎকে সমৃদ্ধ ও নির্মল করাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই তিনি কাজ করে গেছেন জীবনভর। প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল পর্যন্ত দ্বীনের প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে নিরলস শ্রম দিয়ে ৬২৭ হিজরী সনের ৬ রজব ৯০ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান পরপারে।

তিনি ইন্তেকাল করেছেন, কিন্তু তাঁর সুবিশাল অবদান রয়ে গেছে অম্লান। এই উপমহাদেশবাসী তাঁর কাছে চিরঋণী। তিনি শুয়ে আছেন ভারতের আজমীরে। কিন্তু বিরাজ করছেন এতদঞ্চলের প্রতিটি মানুষের মনের মুকুরে।

মুঈনুদ্দীন চিশতী রহ. এর মতো ওলী-দরবেশরা দূরদেশ থেকে এদেশে ছুটে না এলে আমাদের ভাগ্যে কী নির্ধারণ হতো, বলা মুশকিল। তাই আমাদের উচিত ছিল তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। তাদের জীবন ও সাধনাকে যথার্থ উপায়ে চর্চা ও উপস্থাপন করা। কিন্তু আমরা কি আমাদের সে দায়িত্ব পালন করছি? এই মহান সাধককে নিয়ে আজ একশ্রেণীর দরবেশবেশী ধান্দাবাজ রজব মাস এলেই ব্যবসায় নেমে যায়। এভাবে বিকৃত উপায়ে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতির মতো বুযুর্গকে স্মরণ করার কারণে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে তার ব্যক্তিত্বের ছাপ লক্ষ্য করা যায় না। অনেকে তার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন। এটা আমাদের অজ্ঞতা এবং বুযুর্গানে দ্বীন সম্পর্কে উদাসীনতার কারণেই হয়েছে। তাই আজকে সময় এসেছে সবাই মিলে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতির মতো বুযুর্গ ও সাধকদের যথার্থভাবে স্মরণ করা। তাদের অপরিশোধ্য ঋণের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতাবদ্ধ হওয়া।

*

*

Top