ঘাতকের চেয়ে বাঁচানোর মালিক বেশি শক্তিধর

হামিদ মীর
image_79589_0চিকিৎসকরা আমার শরীরের ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করতে এলে পেটে, পায়ে এবং কাঁধের গুলির ছিদ্র দেখে আমি হেসে ওঠি। আপনারা হয় ভাবছেন নিজের গায়ে গুলির ছিদ্র দেখে হাসছি কেন? আজ সকালে আমি নিজেও নিজেকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করেছি। অন্তরের গভীর থেকে আওয়াজ এসেছে, নিরীহ প্রকৃতির এই হাসির পেছনে মূলত আল্লাহর বড়ত্বের স্বীকৃতি রয়েছে। যে ঘাতকরা ১৯ এপ্রিল করাচিতে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে তারা জীবন বাঁচানোর মালিকের সামনে বড়ই নগণ্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। অথচ তাদের কত বড় দুর্ভাগ্য যে, নিজেরাই নিজেদেরকে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি আমাকে বলেছিলেন, ‘নিশ্চিতভাবে হত্যা চেষ্টাকারীদের চেয়ে বাঁচানোর মালিক অনেক বেশি শক্তিশালী। তবে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে।’ তার আশঙ্কা, আমার ওপর আবারো হামলা হতে পারে। আমি সাবেক এই প্রেসিডেন্টের আশঙ্কাকে অনেক বার হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এবার নিজের গায়ে ছয়টি গুলির চিহ্ন নিয়ে তার আশঙ্কাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান এবং আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির প্রধান ইস্কানদিয়ার ওয়ালী পাকিস্তানের ওই রাজনীতিকদের অন্যতম যারা আত্মঘাতী ও হত্যাচেষ্টার হামলা থেকে বারবার বেঁচে গেছেন, তারা উভয়েই আমাকে সতর্ক করেছেন আমি যেন পরবর্তী হামলার ব্যাপারে সতর্ক থাকি।

পাকিস্তানের জাতীয় এই দুই নেতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সুদীর্ঘ সময়ের। তাদের দুজনের সুরে আশঙ্কার মাত্রাটা ছিল বৃটেন থেকে টেলিফোনে মালালার আশঙ্কা প্রকাশের মতোই। দুই বছর আগে পাকিস্তানের সোয়াতে মালালার ওপর গুলি ছোড়া হয়। কিন্তু বীরাঙ্গনা এই মেয়েটির ক্ষেত্রেও দেখা যায় হত্যাচেষ্টাকারীরা বাঁচানোর মালিকের চেয়ে অনেক দুর্বল। মালালার বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই আমার অবস্থা জানতে ফোন করে বললেন, আমার ওপর হামলার খবর পেয়ে তখন তার স্ত্রী কোরআন পাকের ওই সুরাগুলো তেলাওয়াত করেন যেগুলো তিনি মালালার ওপর হামলার পর তেলাওয়াত করেছিলেন।

আমার মতো নগণ্যের জন্য এটা কত সৌভাগ্যের বিষয় যে, লোকেরা আমার সুস্থতার জন্য কোরআন তেলাওয়াত করে দোয়া করেছেন। আমি তাদের যত কৃতজ্ঞতাই আদায় করি তা কমই হবে। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজুল হক বলছিলেন, তিনি দলের শূরার বৈঠকে আমার সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন। মাওলানা সামিউল হক আকুড়াখটকের দারুল উলুম মাদরাসায় আমার জন্য বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছেন। তাদের সবার প্রতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শোকরিয়া। স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আমার জন্য দোয়া করেছেন তাদের সবার প্রতি আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

তবে আব্দুল কাদের বালুচের অনুমানটা সবচেয়ে ব্যতিক্রম। তিনি আমাকে দেখতে হাসপাতালে আসেন। তখন তার ডান হাতে একটি তাসবিহের দানা ঘুরছিল। তিনি অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আফসোস, আমাদের পক্ষে কথা বলায় আপনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তিনি ওই আব্দুল কাদের বালুচ যিনি কিছুদিন আগে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান দাবিতে কোয়েটা থেকে করাচি এবং করাচি থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত লংমার্চ করেছিলেন। তিনি যখন ইসলামাবাদ পৌঁছেন তখন তাকে যারা ‘গাদ্দার’ মনে করেন তারা প্রাণপনে চেষ্টা করেছেন তার এই লংমার্চের খবর যেন গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা না হয়। কিন্তু দেড় হাজার মাইল পায়ে হেঁটে লংমার্চকারী ৭২ বছরের এক বৃদ্ধকে মিডিয়া কিভাবে এড়িয়ে যাবে!

আমি আব্দুল কাদের বালুচ এবং তার সঙ্গী নারী ও শিশুদের টেলিভিশন প্রোগ্রামে উপস্থাপন করি। পরে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নিজে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে আব্দুল কাদের বালুচের সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তার প্রটোকল অফিসার ড. আসিফ কিরমানিকে এর ব্যবস্থা করতে বলেন। আব্দুল কাদের বালুচের দাবিটা অত্যন্ত সাধারণ। তিনি বলেন, আমি বেলুচিস্তানের গুম হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তি চাচ্ছি না। আমি শুধু বলছি, পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী তাদেরকে আদালতে হাজির করা হোক। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী গুম হওয়া ব্যক্তিদের আদালতে হাজির করার সামর্থ্য রাখেন না। এজন্য আব্দুল কাদের বালুচ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি।

আমি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মানবতাবোধের প্রশংসা করি। দুই বছর আগে তিনি পাকিস্তানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পক্ষে রাজপথে দাবি উত্থাপনকারী আমেনা মাসউদের সঙ্গে মিলে এমন হাজারখানেক পরিবারের তালিকা করেন যাদের কেউ না কেউ গুম হয়েছেন। ইসলামাবাদের পাঞ্জাব হাউজে ডেকে তাদের মধ্যে ৫০ লক্ষাধিক রুপিয়ার চেক বিতরণ করেন নওয়াজ শরিফ। সে সময় তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খোঁজ দেবেন বলে ওয়াদা করেন। নওয়াজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন প্রায় এক বছর হতে চলেছে। এখন যখন আমেনা মাসউদ তার ওয়াদার কথা স্মরণ করাতে পুনরায় রাজপথে নেমে আসেন তখন নওয়াজ শরিফের পুলিশ তার ওপর চড়াও হয়, গ্রেফতার করে। নওয়াজ শরিফ কি একথা স্বীকার করবেন যে, তিনিও গুম হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে আগের সরকারের মতোই উদাসীন! তাহলে আগের সরকারের বিরোধিতা করা কি তার জন্য অন্যায় ছিল!

আমি নওয়াজ শরিফের ওপর কৃতজ্ঞ। আমার ওপর হামলার পরদিনই তিনি আগাখান হাসপাতালে ছুটে এসেছেন আমাকে দেখতে এবং চিকিৎসার খোঁজখবর নিতে। আমাকে হত্যাচেষ্টার তদন্ত করতে তিনি সুপ্রিম কোর্টে চিঠিও দিয়েছেন। কিন্তু এর মানে কি এটা, তার শাসনামলে আমেনা মাসউদের মতো মানবতার পক্ষে দাবি উত্থাপনকারীদের রাজপথে অপদস্থ করবেন আর আমি চুপ থাকবো! আমি জানি, নওয়াজ শরিফ ব্যক্তিগতভাবে আব্দুল কাদের বালুচ এবং আমেনা মাসউদকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করেন। কারণ তারা উভয়েই রাজনৈতিক সংগ্রামের পথ অবলম্বন করেছেন, বন্দুক হাতে তুলে নেননি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তিনি সুশীল সমাজের সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই করবেন আর আমরা চুপে থাকবো। নিছক তদন্তের নির্দেশ দিয়েই তার সব দায়িত্বও শেষ হয়ে যায় না।

আজ আমি পাকিস্তানের রাজনীতির ব্যাপারে বেশি কথা বলতে চাই না। এই মুহূর্তে আমি জাতির অনুকম্পায় ডুবে আছি। শোকরিয়া আদায় করছি ওই সাংবাদিক বন্ধুদের যারা আমার ওপর হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। করাচি বার অ্যাসোসিয়েশনসহ আইনজীবীদের সব সংগঠনের প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা। সুশীল সমাজের সদস্যদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা। খৃস্টান, হিন্দু, শিখসহ পাকিস্তানের অন্যান্য অমুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিও শোকরিয়া যারা আমার সুস্থতা কামনা করেছেন। আমার ওপর হামলার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্ব জেনেছে পাকিস্তানে সাংবাদিকরাও নিরাপত্তাহীনতায়। তবে বিশ্ব এটাও দেখেছে, পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ আহত সাংবাদিকের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমার বিশ্বাস, মানুষের ভালোবাসায় আমার এই আঘাত এবং কষ্ট এক নতুন শক্তিতে পরিণত হবে।

স্বস্তির বিষয় হলো, পিপিবির চেয়ারপারসন বিলওয়াল ভুট্টোও আমাকে দেখতে এসে বলেছেন, লোডশেডিংয়ের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার দল নওয়াজ সরকারের বিরোধিতা করবে। তবে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের প্রশ্নে প্রয়োজনে তারা নওয়াজ শরিফের পাশে দাঁড়াবে। এভাবে কিছু লোক গণতন্ত্রের গাড়িকে খাদ থেকে উঠাতে সরব হয়েছেন। এ ঘটনায় রাজনীতিক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ পেশাদাররা গণতন্ত্র সুরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। আহত গণতন্ত্র ও আহত সাংবাদিকতা উভয়েই নিজ পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি গণতন্ত্র ও সাংবাদিকতার গায়ে আঘাতের চিহ্ন দেখে হাসছি। আমার বিশ্বাস, ঘাতকের চেয়ে বাঁচানোর মালিক অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী।

১ মে ২০১৪ বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের দৈনিক জং-এ প্রকাশিত উর্দু থেকে অনুবাদ।

হামিদ মীর: পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক। প্রধান নির্বাহী, জিও টিভি।

Related posts

*

*

Top