চেতনায় বালাকোট

Balakot--one of the Plan communities severely affected by the eaউপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে বালাকোট একটি স্মরণীয় নাম। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলমানদের স্বাধীনতা, অস্তিত্ব ও জাগরণের ইতিবৃত্ত; পথহারা উম্মতের সঠিক পথের নির্দেশনা। ইংরেজ আমলে পরবর্তী সময়ে সংঘটিত প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম, গণঅভ্যুত্থান বালাকোটের চেতনার ফসল। বালাকোটের ঐতিহাসিক ট্রাজেডির মাধ্যমে সূচিত সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়েই এ দেশের মুসলমানরা ফিরে পেয়েছিল তাদের স্বাধীনতা।
বালাকোট আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন সৈয়দ আহমদ রহ.। মুজাদ্দিদে আলফে সানীর সূচিত সংস্কার ও সংগ্রামের ধারার সুযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি। তাঁর আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল মূলত দুটি উদ্দেশ্যেÑএক. পারিপার্শ্বিক নানা প্রভাবে কলুষিত মুসলিম জাতির ঈমান-আকিদাকে শিরকমুক্ত করা। দুই. মুসলিম জীবনধারা ও জাগরণের অন্তরায় অশুভ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। অস্তিত্ব হারাতে বসা মুসলিম জাতির জন্য তখন এ দুটি কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী ও প্রয়োজনীয়।
মোঘল সালতানাতের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উপমহাদেশের মুসলমানরা নিপতিত হয় চতুর্মুখী সমস্যায়। একদিকে জাঠ-মারাঠা-শিখ প্রভৃতি মুসলিমবিদ্বেষী শক্তির ব্যাপক অভ্যুত্থান, অপরদিকে বাংলার শাসন ক্ষমতায় ইংরেজ বণিকদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে অশুভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সে সময়ে মুসলিম জনগণের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। মসজিদে আজান এবং জুমার জামাত বন্ধ হয়ে যায়। অবস্থার ভয়াবহতা সেই সময় সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.কে আন্দোলনের পথে তাড়িত করে। তিনি প্রথমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ব্যাপক তাবলিগি সফর শুরু করেন। এই যাত্রাপথে তিনি বাংলার যুবকদেরও তাঁর আন্দোলনে শরিক করেন। বাংলাদেশ থেকেও অনেক মুজাহিদ এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। এর মধ্যে মাওলানা ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী ও সুফি নূর মুহাম্মদ ছিলেন শীর্ষ পর্যায়ে। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের এক পরদাদা গাজী আশেকুল্লাহও ছিলেন এ পর্যায়ের এক সংগ্রামী আলেম। দু’বছর এগার মাসের হজের সফর সমাপ্ত করে সৈয়দ আহমদ রহ. তাঁর জন্মস্থান রায়বেরেলি পৌঁছেন। দেশে এসে তিনি তাঁর আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন সর্বত্র। জনগণের জন্য মুক্ত স্বাধীন দেশে আল্লাহর বন্দেগি করার মতো মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার দৃঢ় প্রত্যয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন। নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে তাঁর আন্দোলনে জড়াতে থাকে।
এ সময় ব্যাপক গণসংযোগের দ্বারা তিনি প্রায় ছয় হাজার সঙ্গী-সাথী সংগ্রহ করেন। তাদের সংগঠিত করে সীমান্ত এলাকায় চলতে থাকা মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ইংরেজ রাজশক্তির মদদপুষ্ট শিখ রাজার শোষণ প্রতিরোধকল্পে ১৮২৬ খৃস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। শিখ রাজা রঞ্জিত সিংকে প্রথমে পত্র মারফত মুসলিম নির্যাতন বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়। শিখ রাজা পত্রের কোনো জবাব না দিয়ে মুজাহিদদের কাফেলাকে শায়েস্তা করার জন্য সরদার বুধসিংয়ের নেতৃত্বে এক বিশাল বাহিনী পাঠিয়ে দেয়। মুসলিম বাহিনীর সঙ্গে এটাই ছিল শিখদের সর্বপ্রথম মোকাবেলা। এতে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। এরপর ‘হাযারা’ নামক স্থানে দ্বিতীয়বার সংঘর্ষ হয়। এতেও শিখরা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়। এই বিজয়ের ফলে মুসলমানদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি হয়। এসব যুদ্ধের পেছনে কারণ ছিল মুসলমানদের জীবন নিপীড়নমুক্ত করা, ইংরেজ ও ইংরেজপোষ্য শাসকদের কাবু করা। সম্প্রদায়গতভাবে শিখদের সঙ্গে লড়াই করা এর লক্ষ্য ছিল না। সে সময় মুজাহিদীন ও উপজাতীয় সরদারদের এক সমাবেশে সৈয়দ আহমদ শহীদকে ‘আমিরুল মুমেনিন’ করে ইসলামী খেলাফতের গোড়াপত্তন করা হয়। মুজাহিদ বাহিনীর আন্দোলন এতে নতুন মোড় লাভ করে।
কিন্তু সৈয়দ আহমদ রহ.-এর এই আন্দোলনে উপজাতীয় পাঠানদের সমর্থন ছিল না। কারণ, শিখদের সঙ্গে এদের নানা ধরনের বৈষয়িক স্বার্থ জড়িত ছিল। যুগ যুগ ধরে তারা গদি দখল করে সাধারণ জনগণকে শোষণ করে আসছিল। তাই সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে তাদের একটি সুস্পষ্ট বিরোধ জন্ম নেয়। ফলে তারা শিখদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গোপন চক্রান্তে মেতে উঠে। সংঘটিত হয় ‘সিদুর’ যুদ্ধ। কিন্তু এই যুদ্ধে মুজাহিদদের আংশিক পরাজয় ঘটে। নানামুখী প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে তারা কিছুটা দমে যান। এরই মধ্যে ঘটে এক করুণ ঘটনা। একদিন মুজাহিদরা এশার নামাজ আদায় করছিলেন। এ সময় তাদের ওপর এক অতর্কিত হামলা হয়। এতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুজাহিদ নির্মমভাবে শহীদ হন। এই ঘটনায় মুজাহিদদের মনোবল অনেকটা ভেঙে যায়। সৈয়দ আহমদ রহ. প্রত্যেককে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাবার অনুমতি দেন। কিন্তু অনেকেই তাকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি। অবশিষ্ট মুজাহিদদের নিয়ে সৈয়দ আহমদ রহ. পেশোয়ার উপত্যকা থেকে কাগানের পার্বত্য এলাকা দিয়ে অগ্রসর হন। কিন্তু বালাকোটের কাছে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে সরদার সেরসিংয়ের নেতৃত্বে একটি বিরাট শিখ সৈন্যবাহিনী এসে সমগ্র এলাকা ঘিরে ফেলে। মূলত পাঠানদেরই একটি গ্রুপ শিখদের এখানে নিয়ে আসে। ফলে বালাকোটের ময়দানে সংঘটিত হয় চূড়ান্ত ও শেষ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে মুজাহিদ বাহিনী বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। কিন্তু কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতায় সৈয়দ আহমদ রহ., শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ.সহ প্রায় দুশ মুজাহিদ শহীদ হন। দিনটি ছিল ১৮৩১ খৃস্টাব্দের ৬ মে।
balakot2এর মাধ্যমে সমাপ্ত হয় দীর্ঘ জিহাদি আন্দোলনের এক অধ্যায়। দীর্ঘ সংগ্রামের প্রবাহিত ধারা এখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। রক্তের আখড়ে লেখা হয় বালাকোটের ঐতিহাসিক ট্রাজেডির কথা। তবে সৈয়দ আহমদ রহ. তাঁর লক্ষ্য অর্জনে অনেকাংশেই সফল হয়েছিলেন। সীমান্তের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের মানষেরা শিখদের নির্যাতনের যাঁতাকল থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছিলেন। উপরন্তু পেশোয়ারকেন্দ্রিক একটি ইসলামী খেলাফত কায়েম করে চার বছরাধিককাল তা পরিচালনা করে সফল দৃষ্টান্তও তিনি স্থাপন করেছেন। যা পরবর্তী যুগের ঈমানদীপ্ত মুসলমানদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে সংঘটিত সিপাহী বিপ্লব, রেশমি রোমাল আন্দোলন, আযাদী আন্দোলন, দেওবন্দ আন্দোলন, আলীগড় আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন, সংগ্রাম ও বিপ্লবই বালাকোটের প্রেরণা ফসল।
বালাকোট মূলত একটি চেতনার নাম। এই নামটি ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের উজ্জীবিত করে। এর চেতনা আমাদেরকে সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। বালাকোটের শিক্ষাও এই অঞ্চলের মুসলমানদের বিশেষ পাথেয়। ঝলসে ওঠা একটি আন্দোলনকে মুখোশধারী মুনাফিকরা কিভাবে আপাত ব্যর্থ করতে পারে এর জ্বলন্ত উদাহরণ বালাকোট। এজন্য সব সময় সজাগ থাকতে হবে, চেতনার সিঁড়ি বেয়ে ছড়িয়ে পড়া কোনো আন্দোলন ও সংগ্রাম যেন গুটিকতক মুনাফিক ও স্বার্থান্বেষী মানুষের জন্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয়। বালাকোটের অবিনাশী চেতনা শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদেরকে পথ দেখাবে এগিয়ে চলার। চেতনার বাতিঘর অনুসরণ করে চললে মুসলিম জাতি কখনও পথ হারাবে না।

Related posts

*

*

Top