তোমাকেই নিতে হবে আগামীর পৃথিবীর ভার

জহির উদ্দিন বাবর
মহামারি করোনাভাইরাসের থাবায় বিশ^ এখনও প্রায় থমকে আছে। জীবনে যা কেউ কল্পনাও করেনি এমনটা ঘটেছে গত কয়েক মাসে। প্রায় ছয় মাস ধরে চলা বৈশি^ক এই মহামারি আমাদের জীবনধারা তছনছ করে দিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক না হলেও আস্তে আস্তে প্রায় সবকিছু সচল হতে শুরু করেছে। যদিও এখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেনি। শিগগির খুলবে বলে আশা করা হচ্ছে। করোনার কারণে এবার আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে কওমি মাদরাসাগুলো অতিক্রম করছে চরম সংকটকাল। রমজানের পর শাওয়াল মাসে কওমি শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়। কিন্তু এবার করোনার কারণে এখনও শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়নি। এমনকি গত বছরের কেন্দ্রীয় ও বার্ষিক পরীক্ষাও হয়নি। বিশেষ করে দাওরায়ে হাদিসে যাদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা তারা অপেক্ষায় আছেন। মাদরাসা খোলার পরপর সেই পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে।
কওমি মাদরাসার সম্মিলিত বোর্ড আল হাইয়্যাতুল উলয়ার অধীনে সারাদেশের তাকমিল ফিল হাদিস বা দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দেবেন। পঁচিশ হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা কওমি শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর সম্পন্ন করবেন। অনেকে এরপরেও উচ্চতর পড়াশোনা করেন। কিন্তু বেশির ভাগ এখানেই শিক্ষাজীবনের ইতি টানেন। এ হিসেবে যারা দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করছেন তাদের জন্য এই পরীক্ষাটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পরবর্তী জীবনের অনেক কিছু নির্ভর করে এর ওপর। যদিও দীনি ইলমের ক্ষেত্রে যোগ্যতা অর্জনই বড়, পরীক্ষা মুখ্য নয়; তবুও পরীক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, যার পরীক্ষায় ভালো করার প্রচেষ্টা থাকবে সে ইলমি যোগ্যতায়ও নিঃসন্দেহে এগিয়ে থাকবে।
দাওরায়ে হাদিসে সাধারণত হাদিসের বিশুদ্ধ ছয় কিতাব বা সিহাহ সিত্তাহ পড়ানো হয়ে থাকে। বছরজুড়ে শিক্ষার্থীরা শুধু হাদিসের চর্চাই করেন। প্রতিটি দরসে তাদের সামনে ইলমের এক একটি প্রান্তর উন্মোচিত হয়। মূলত এতো অল্প সময়ে ইলমে হাদিসের বিশাল ভা-ার থেকে খুব বেশি অর্জনের সুযোগ থাকে না। তবে সেটা নির্ভর করে শিক্ষার্থীর চেষ্টা ও সাধনার ওপর। পুরো বছর যাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে কিছু গ্রহণ করার তাদের অনেক কিছু অর্জিত হয়। আবার অনেকে হেলায়-খেলায় বছর কাটিয়ে দিয়ে শেষ সময়ে এসে অনুশোচনায় ভোগেন। তবে এবার যেহেতু নির্ধারিত সময়ের অনেক পর এই পরীক্ষা হচ্ছে আশা করা যায় শিক্ষার্থীদের সবাই প্রস্তুতি গ্রহণের পর্যাপ্ত সময় পেয়েছেন। তবে এটাও সত্য, নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা না হওয়ায় অনেকের পড়াশোনায় ছন্দপতন ঘটেছে। লকডাউনের কয়েক মাস হয়ত কিতাবাদি সেভাবে পড়ার সুযোগ হয়নি। এজন্য দাওরায়ে হাদিসের শিক্ষার্থী বন্ধুদের উচিত পরীক্ষার আগের সময়টুকু যথাযথভাবে কাজে লাগানো। জীবনের জন্য বিশেষ পাথেয় যোগাড়ের চেষ্টা করা।
সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষার একটি বড় পার্থক্য আছে। সাধারণ ধারায় পড়াশোনায় যোগ্যতার চেয়ে বড় টার্গেট থাকে পরীক্ষা। অনেকে যোগ্যতা যেমনই হোক পরীক্ষায় ভালো করেন, আর তাদেরকে সার্টিফিকেট দেখে সমাজের বিভিন্ন স্তরে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু মাদরাসাপড়–য়াদের মনে রাখতে হবে, পরীক্ষা মুখ্য বিষয় নয়। আসল বিষয় হচ্ছে যোগ্যতা। সবমিলিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় আপনি যা শিখলেন, অর্জন করলেন তা পরবর্তী সময়ে প্রতিটি পদে পদে কাজে লাগবে। দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার বিদ্যা কিন্তু শেষ নয়। আপনাকে সমাজে যেতে হবে, দীনের খেদমত করতে হবে, অর্জিত শিক্ষা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। সেখানে আপনি দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় কোন বিভাগে পাস করেছেন সেটা খুব কমই দেখা হবে। সেখানে দেখা হবে আপনি অর্জিত বিদ্যা অনুযায়ী মানুষকে কতটুকু দিতে পারছেন। এজন্য মাদরাসার চূড়ান্ত ধাপের শিক্ষার্থীদের সবসময় বিবেচনায় রাখতে হবে, আমি আমার শিক্ষা দ্বারা সমাজকে উপকৃত করার যোগ্যতা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি। পারলে আলহামদুলিল্লাহ, আর না পারলে আমাকে পস্তাতে হবে।
কওমি মাদরাসায় সর্বোচ্চ স্তর তাকমিলে হাদিসের কিতাবগুলো পড়ানোর উদ্দেশ্য নিছক কিছু প্রশ্ন আয়ত্ত করে পরীক্ষায় ভালো নাম্বার তোলা নয়। দীনের অন্যতম অপরিহার্য বুনিয়াদি বিষয় হাদিস বোঝা, সেই অনুযায়ী আমল করা এবং তা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়ার মতো যোগ্য আলেম গড়ে তোলাই এর মূল উদ্দেশ্য। এজন্য যারা হাদিস পড়ছেন তাদের প্রথমে প্রতিটি হাদিস যথাযথভাবে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এখন যে হাদিসটি পড়ছেন তা আর জীবনে দ্বিতীয়বার পড়ার সুযোগ নাও মিলতে পারে। তাই হাদিসটি এমনভাবে আয়ত্ত করুন যাতে সারা জীবন তা মনে থাকে। আর হাদিস মনে রাখার সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম হলো এর ওপর আমল শুরু করে দেওয়া। আমলের মাধ্যমে যে হাদিস আয়ত্ত করা হয় তা জীবনেও ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। এজন্য আমরা যখন হাদিসগুলো পড়ব প্রতিটি হাদিস আমলের নিয়তে পড়বো।
সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করে যারা কর্মক্ষেত্রে পা রাখতে যাচ্ছেন তাদের জন্য এই সময়টি জীবনের একটি টার্নিং পয়েন্ট। আজ যারা ছাত্র কিছুদিন পর তাদের অনেকেই শিক্ষকতার আসনে বসবেন। তখন আপনার দায়িত্ব যে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ থেকেই দায়িত্বের প্রতি যতœশীল হোন। সেই দায়িত্ব পালনের মতো যোগ্য করে নিজেকে গড়ে তুলুন। শুধু একাডেমিক শিক্ষায় সেই দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না, লাগবে আরও বহুমাত্রিক যোগ্যতা। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই পাঠশালার মতো। আপনার আশপাশে শিক্ষার নানা উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আপনাকে সেখান থেকে তা আহরণ করতে হবে। এটা যে যত বেশি আহরণ করতে পারবে কর্মক্ষেত্রে সে তত সফল হবে।
আপনি এক যুগের বেশি পড়াশোনা করে আলেম হয়ে সমাজে যাচ্ছেন, স্বাভাবিকভাবেই আপনার প্রতি সমাজের চাওয়া অনেক বেশি। সেখানে গিয়ে কাজের মাধ্যমে আপনাকে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। জাগতিক শিক্ষার ধাপগুলো শেষ করার পর সাধারণত প্রত্যেকে নিজের ক্যারিয়ার নিয়েই ডুবে থাকেন। ভালো কোনো কর্মসংস্থানই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে। সমাজের প্রতি তাদের যেমন খুব বেশি দায়বদ্ধতা নেই সমাজও তাদের থেকে বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না। কিন্তু একজন নবীন আলেম এলাকায় এসে নতুন করে নাড়া দেবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেন সমাজের মানুষেরা। এজন্য নিছক নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে না ভেবে একজন নবীন আলেমকে সমাজের প্রয়োজনের কথাও ভাবতে হয়। এমনকি সমাজের চাহিদা বিবেচনা করে অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াকে পেছনে রেখে দিতে হয়। কাজেই সমাজের জন্য কিছু করার মানসিকতা নিয়েই আমাদের কর্মক্ষেত্রে পা রাখা উচিত।
নিজেকে নিয়ে ভাবার মতো লোক এই সমাজে অভাব নেই। দেশ, জাতি ও সমাজকে নিয়ে ভাববে, উম্মাহর দরদ অন্তরে পোষণ করবে এমন মানুষের আজ নিদারুণ অভাব। আমাদের মাদরাসাগুলো থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার আলেম বের হচ্ছেন, দীনের বিভিন্ন অঙ্গনে তারা কাজও করছেন, তবে উম্মাহর প্রতি সত্যিকারের দরদ থেকে কাজ করার মতো লোকের এখনও প্রচুর সংকট রয়ে গেছে। কারণ ত্যাগের চেয়ে ভোগের প্রতি আমরা বেশি আসক্ত। দেওয়ার চেয়ে পাওয়ার দিকে আমাদের নজর থাকে বেশি। দায়িত্ব পালনের চেয়ে অধিকার আদায়ের প্রতি আমাদের সচেষ্টতা বেশি। ‘এ জীবন মরণ সবই পরের তরে’ কবির সেই বাসনা পূরণ করার মতো লোক আজ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অথচ সমাজের চেহারা বদলে দেওয়ার জন্য, উম্মাহর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এ ধরনের লোকেরই বেশি প্রয়োজন। জীবনকে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই শুভক্ষণে আমরাও পারি নিজেকে পরের জন্য উৎসর্গ করতে। ‘ত্যাগেই সুখ’ এই দীক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করতে পারলে আমাদের দ্বারা দেশ, জাতি ও উম্মাহ কিছুটা হলেও উপকৃত হবে সেই আশা করা যায়। তাই প্রিয় বন্ধুরা! আসুন, প্রাচ্যের কবি আল্লামা ইকবালের কবিতার সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করি:
‘শিক্ষা লও ন্যায় ও সততার/তোমাকেই নিতে হবে আগামীর পৃথিবীর ভার।’

Related posts

*

*

Top