বাবা-মায়ের ভালোবাসাও কি দিবসসংস্কৃতিতে হারিয়ে যাবে?

zahirbabor.comবাবার প্রতি ভালোবাসা জানিয়ে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোবরারে পালন করা হয় দিবসটি।  এবার ১৮ জুন পালিত হচ্ছে দিবসটি। মিডিয়ার কল্যাণে দিনদিন অখ্যাত এবং ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পরিচিত নয়-এমন দিবসও হাঁকডাকের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। দিবসকে কেন্দ্র করে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক  উভয় মিডিয়া সরব হয়ে ওঠে। প্রিন্ট মিডিয়ায় এসব দিবসের ওপর বিশেষ ক্রোড়পত্র ও বিশেষ সংখ্যা বের করে। আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বিশেষ নাটক, টেলিফিল্ম, আলোচনা ও পর্যালোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। মিডিয়ার কাছে দিবসের তাৎপর্যের চেয়ে এর দ্বারা ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলই মুখ্য। কারণ বিশেষ দিবসের বিশেষ আয়োজনে স্পেশাল স্পন্সর মেলানো সহজ হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এসব দিবসে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচার করতে বেশ আগ্রহবোধ করে। এভাবেই আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে দিবসসংস্কৃতির সয়লাব ঘটছে। নিত্য-নতুন এমন সব দিবসের সঙ্গে আমরা পরিচিত হচ্ছি যেগুলো দিবসখ্যাতি পাবে বলে কেউ কোনোদিন চিন্তাও করেনি। পৃথিবীতে সবচেয়ে আপনজন হচ্ছেন মা-বাবা। সন্তানের কাছে বাবা-মা সব সময়ই শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্পর্কের গভীরতায় অনন্য সাধারণ। কোনো সন্তানেরই তাদের প্রকৃত ঋণ শোধ করার সামর্থ্য নেই।
ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও নৈতিক মূল্যবোধ-সব বিচারেই মা-বাবার স্থান শীর্ষশিখরে। অপরিশোধ্য ঋণে দায়গ্রস্ত প্রতিটি সন্তানেরই উচিত সব আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার আবেশে মা-বাবাকে সিক্ত করে তোলা। সাধ এবং সাধ্যের সবটুকু বিলিয়ে হলেও তাদের জন্য কিছু করার ব্যাপারে প্রত্যয়ী হওয়া। সন্তান যেদিন থেকে বাবা-মায়ের সন্তান-সেদিন থেকেই এই দায়বোধ তার কাঁধে অর্পিত হয়। সন্তানের অস্তিত্ব ও বিকাশের প্রতিটি ধাপেই সে তার জন্মদাতা মা-বাবার কাছে ঋণী। কোনো দিন-ক্ষণের হিসাব কষে এ ঋণ কখনো পরিশোধ হওয়ার নয়। কারণ বৈষয়িক হিসাব-নিকাশ, গতানুগতিক সম্পর্কের সীমারেখা এবং স্বার্থের অশুভ টানাপোড়েনের অনেক ঊর্ধ্বে এ বন্ধন। শাশ্বত, অকৃত্রিম ও আবিলতামুক্ত এই সম্পর্ককে পৃথিবীর আর কোনো সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। সন্তান বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসবে, তাদের ঋণ পরিশোধে আন্তরিক হবে-এটা সন্তানের নৈতিক, মানবিক ও সর্বোপরি ধর্মীয় দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সদা-সর্বদা সচেষ্ট থাকা সন্তানের অনিবার্য কর্তব্য। এর জন্য সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ ঠিক করার প্রয়োজন বোধ হয় না। কারণ এর পেছনে লুকিয়ে থাকে স্বার্থের বিকৃত অনুভূতি এবং নির্মমতার প্রতিচিত্র। নিঃস্বার্থ, নিবেদিত ও অনাবিল নিখুঁত সম্পর্কের পরিপন্থী কিছু উপসর্গ। এজন্য মানবপ্রকৃতির সহায়ক ধর্ম ইসলাম এসব সম্পর্ককে দিন-ক্ষণের সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ করার ঘোরবিরোধী।
দিবসসর্বস্ব ভালোবাসা এবং ঋণগ্রস্ততার জন্য ক্ষণিকের ভাবনাকে ইসলাম সমর্থন করে না। মা-বাবাকে কেন্দ্র করে, সুনির্দিষ্ট দিন-ক্ষণে তাদের প্রতি সস্তা ভালোবাসা এবং আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো ইসলাম পছন্দ করে না। শুধু তাই নয়, দিবসসর্বস্ব ও আনুষ্ঠানিকতানির্ভর কোনো বিষয়ই ইসলামের প্রান্তসীমার ভেতরে পড়ে না। দিবসসংস্কৃতি ও আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব এসব আয়োজন মূলত আমাদের দেশীয় উৎপত্তি নয়। পাশ্চাত্যের সূচিত অপসংস্কৃতিক উৎস থেকে আমরা এগুলো ধার করে নিয়েছি। সেখানকার সামাজিক ব্যবস্থা এবং তাদের জীবনবোধের সঙ্গে এগুলো অনেকটাই মানানসই ও প্রয়োজনপ্রসূত। পশ্চিমা বিশ্বে বৃদ্ধ মা-বাবা সন্তানের জন্য বোঝা, এ বোঝা সরাতে পারলেই যেন তারা বাঁচে! এজন্য তারা তাদের বৃদ্ধ মা-বাবাকে শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে তাদের দায় থেকে মুক্ত হতে চায়। সারা বছর বৃদ্ধাশ্রমে পড়ে থাকা মা-বাবার খোঁজ-খবর নেয়ার প্রয়োজন তারা বোধ করে না অথবা এ সুযোগ তাদের হয়ে ওঠে না। ফলে তারা মা-বাবার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য একটি দিন-ক্ষণ ঠিক করে নিয়েছে। এ দিনে ফুল দিয়ে, বিভিন্ন গিফটসামগ্রী পাঠিয়ে মা-বাবাকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের প্রতি দরদ ও ভালোবাসার উতলা প্রকাশ ঘটায়। ‘আজ শুধুই মা অথবা বাবাকে ভালোবাসার’, ‘আজকের দিন শুধুই বাবার জন্য অথবা মায়ের জন্য’-এ ধরনের আবেগী শ্লোগানের মাধ্যমে এ দিবসগুলো অন্যদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় করে তুলেছে। সেসব সংস্কৃতির অবাধ বিচরণগাহ আমাদের দেশেও বর্তমানে এসব দিবস বেশ আলোচিত ও প্রসিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে এ দিবসের কোনো বাস্তবতা ও প্রয়োজন আদৌ আছে কি না সে জিনিসটি কেউ খতিয়ে দেখছি না।
আমাদের সমাজব্যবস্থা এখন পর্যন্ত অনেকটা শালীন ও বাঞ্ছিত ধারায় বহমান। এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ লোক এখন পর্যন্ত তাদের মা-বাবার অনুগত এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করে। শেষ বয়সে অপদার্থ বানিয়ে মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়ার মতো নির্মমপ্রকৃতির সন্তান এখন পর্যন্ত এদেশে ব্যাপকতা লাভ করেনি। ঋণ পরিশোধে আন্তরিক কি-না এটা বড় কথা নয়; তবে মা-বাবার প্রতি ঋণবোধ ও দায়বোধ যে এদেশের প্রতিটি সন্তানকে তাড়িত করে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্নভাবে। সুতরাং মা-বাবার প্রতি দিবসসর্বস্ব ভালোবাসা পোষণ করা এদেশীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। পশ্চিমা সংস্কৃতির অনেক কিছু রপ্ত করার পাশাপাশি আমরা আজ দিবসসংস্কৃতিটিকেও ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে নিচ্ছি। দিবসনির্ভর অনেক অপসংস্কৃতি তো আছেই, বাবা দিবস-মা দিবসকে কেন্দ্র করে পর্যন্ত এমন কিছু কাজ করা হচ্ছে যা বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের প্রগাঢ় ও নিবিড় সম্পর্কে চিড় ধরায়। যেমন বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের গভীর সম্পর্কের যোগসূত্রতা আছে সত্য, কিন্তু উভয়ের মধ্যে শ্রদ্ধা ও প্রীতির একটা অস্ফুট সীমারেখাও আছে। আচরণগত কিছু বাধ্য-বাধকতাও উপেক্ষা করার নয়। সন্তান এবং বাবা-মায়ের যে সম্পর্ক সেটিই দুনিয়ার সবচেয়ে প্রগাঢ় ও প্রকৃষ্ট সম্পর্ক-এতে বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্কের অযাচিত অনুপ্রবেশ নিবিড় এই সম্পর্ককে নড়বড়েই করে না, স্থান বিশেষে ছিন্নও করে দেয়। দিবসসংস্কৃতিনির্ভর ভালোবাসা এবং দিবসিক সম্পর্ক স্থায়ী ও দৃঢ় কোনো সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে না। প্রগাঢ়, আবিলতামুক্ত, সুদৃঢ় সম্পর্কের প্রকৃষ্ট বন্ধনে আবদ্ধ বাবা-মা এবং সন্তানের সম্পর্ককে কোনো দিবসের ভেড়াজালে বন্দী করে এর স্বকীয়তা বিনষ্ট করা মানবসভ্যতার জন্য সুখকর নয়।

*

*

Top