বিশুদ্ধ ভাষা চর্চা ও ইসলাম

128ভাষা আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান। ইসলাম প্রতিটি ভাষাকেই বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে বিবেচনা করে। বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়ার কারণে একমাত্র আরবী ছাড়া সব ভাষার স্তর প্রায় এক। তবে ইসলাম বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে মাতৃভাষা শিক্ষার প্রতি। কালের পরিক্রমায় যত নবী-রাসূল দুনিয়াতে এসেছেন ঐশী বার্তা নিয়ে তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন স্ব স্ব মাতৃভাষার পণ্ডিত। নবী-রাসূলদের মাতৃভাষায় দক্ষ করে পাঠানোর কারণ হলো, তারা যেন স্বজাতির কাছে যথার্থভাবে দাওয়াত উপস্থাপন করতে পারেন। বাংলা ভাষা অধ্যুষিত আমাদের এই ভূখণ্ডে কোনো নবী-রাসূল এসেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। এতদ অঞ্চলে কোনো নবী বা রাসূল এলে অবশ্যই তিনি হতেন বাংলাভাষী। বাংলা ভাষাকে নির্ভর করেই পরিচালিত হতো তার দাওয়াতি মিশন।
ভাষা হিসেবে বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও প্রাচীন। এদেশে বাংলা ভাষার প্রাচীনত্বের চেয়ে ইসলাম আগমনের সময়সীমাটি কম নয়। তবে বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে অষ্টম শতাব্দীতে, আর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ইসলামের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে আরো কয়েক শতাব্দী পরে। ১২০৩ সালে তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। মুসলিম শাসনের সূচনাকাল থেকে পলাশীর বিপর্যয় অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত এই সাড়ে পাঁচশ বছর ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রকৃত অর্থে স্বর্ণকাল। বাংলার মুসলিম শাসকরা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে বাংলা চর্চার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধির জন্য তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কবি, সাহিত্যিক ও ভাষাবিদদেরকে মুসলিম রাজা-বাদশারা বিশেষ আনুকূল্য দিতেন। সে সময় রাজ দরবারগুলো ছিল শিল্প-সাহিত্যের চর্চাকেন্দ্র। মধ্য যুগে মুসলিম লেখকদের হাতে জন্ম নেয়া সাহিত্য বাংলা ভাষাকে ঋদ্ধ ও পরিপুষ্ট করেছে।
প্রত্যেক জাতির ভাষা জাতীয় সম্পদ। ভাষার বিকাশ ও চর্চায় সে ভাষাভাষী সব শ্রেণীর মানুষের সক্রিয় ভূমিকা থাকে। কোনো ভাষাই একক কোনো গোত্র-গোষ্ঠীর কৃতিত্বের ফসল নয়। সে হিসেবে বাংলা ভাষাও আমাদের সার্বজনীন ভাষা। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের কাছে তার ভাষা মায়ের মতোই আপন। নিজের মাকে সম্মান কিংবা অবজ্ঞা করা কোনো ধর্মই যেমন স্বীকৃতি দেয় না তেমনি মাতৃভাষার মর্যাদাহানিও কোনো ধর্মই মেনে নিতে পারে না। মানবপ্রকৃতির ধর্ম ইসলাম এক্ষেত্রে আরো বেশি রক্ষণশীল।
ভাষাকে আল্লাহ তায়ালা তার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেছেন। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তার এক নিদর্শন হলো, তোমাদের রং, ধরণ এবং ভাষার বিভিন্নতা।’ ভাষা ছাড়া মানবসভ্যতা অচল। বাকহীন নিথর কোনো ভূখণ্ডে বেঁচে থাকা কতটা যে দুর্বিসহ তা বোঝানো মুশকিল। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানবসভ্যতাকে ছন্দময় করে তোলার জন্যই আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে দান করেছেন ভাষার নেয়ামত। সব প্রাণীরই স্ব স্ব ভাষা আছে, নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের মাধ্যম জানা আছে। কিন্তু মানুষের ভাষার মতো এত স্বচ্ছন্দ, সহজাত ও সমৃদ্ধ ভাষা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। প্রথম মানুষ হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টির করার পর সর্বপ্রথম তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়েছে ভাষা। আর মানুষের ভিন্নতার কারণে ভাষায়ও এসেছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য। সময়, স্থান ও মানুষের এই বিচিত্রতার কারণেই পৃথিবীতে অস্তিত্ব¡ লাভ করেছে কয়েক হাজার ভাষা। মর্যাদার বিচারে সব ভাষাই গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রত্যেকের কাছে তার মায়ের ভাষা সেরা। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ত্যাগে মায়ের ভাষার সমকক্ষ আর কোনো ভাষা নেই।
মহান স্রষ্টা নিজেও মাতৃভাষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। যুগে যুগে মানুষের হেদায়াতের জন্য তিনি যত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষায় যোগ্য ও দক্ষ করে পাঠিয়েছেন। যখন যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন তা নবীদের মাতৃভাষায় করেছেন। প্রত্যেক নবীই ছিলেন মাতৃভাষার পণ্ডিত। তাদের ওপর অবতীর্ণ কিতাবগুলোও ছিল স্বজাতীয় ভাষায়। প্রত্যেক নবী-রাসূলের ভাষাকেই আল্লাহ তায়ালা সুমিষ্ট ও সাবলীল করেছিলেন, যাতে লোকেরা সহজেই বুঝতে পারে। আর দাওয়াতে দ্বীনের কৌশলও হলো সুমিষ্ট ও বোধগম্য ভাষায় দাওয়াত উপস্থাপন করা। একজন দা’য়ীর বড় গুণ হলো, তার মাতৃভাষায় যথার্থ যোগ্যতা অর্জন করা।
মুসলিম সমাজে প্রচলিত ভাষাই মুসলমানদের ভাষা। সে ভাষা মায়ের মতোই আপন, গভীর মমতায় নিবিষ্ট। নিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সে ভাষা চর্চা করলে তা ইবাদত হিসেবেই গণ্য হবে। কোনো নবী বা আসমানি কিতাব যদি এ জনপদে অবতীর্ণ হতো তাহলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় তা বাংলাতেই হতো। তাই প্রত্যেক ভাষাভাষীর দায়িত্ব হলো, নিজ নিজ মাতৃভাষাকে চর্চার মাধ্যমে সমুজ্জ্বল করে তোলা।
পৃথিবীর সব ভাষাই আল্লাহর বিশেষ দান। যুগে যুগে প্রেরিত লক্ষাধিক নবী-রাসুল নানা ভাষায় কথা বলতেন। তবে তাদের সবারর প্রয়োগ ও বৈশিষ্ট্য ছিল প্রায় একই। তাদের ভাষা ছিল সুন্দর, মার্জিত ও রুচিসম্মত। হাদিসে আছে, রাসূল (সা.) বলেন, ‘ইসলাম হচ্ছে সুন্দর ভাষায় কথা বলা ও ক্ষুধার্তকে খাওয়ানো।’একটি মন্দ ও কর্কশ কথা অপমানজনক উক্তি মানবহৃদয়ে দীর্ঘকালীন রক্তক্ষরণ ঘটায়, যার উপশম সহজে হয় না। আমাদের প্রিয়নবীর (সা.) মধুর ভাষা শুনতে, সুন্দর আচরণ দেখতে অমুসলিমরাও ভিড় করতো। ইসলাম মূলত তলোয়ার নয় সুন্দর ভাষা ব্যবহার ও সুস্বভাবের কারণেই বিশ্বময় ব্যাপ্তি লাভ করছে।
আমরা জিহ্বার সাহায্যে কথা বলি, মনের ভাব প্রকাশ করি। জিহ্বার অপব্যবহারের জন্য আল্লাহ কেয়ামতে প্রশ্ন করবেন বলে কোরআনে উল্লেখ আছে। কর্কশ ও রুঢ় কণ্ঠে কথা বলা একধরনের জিহ্বার অপব্যবহার। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা ভাষায় মিষ্টভাষি হও, আচরণে সংযমি হও। তিনি কর্কশ ভাষি না হতে আল্লার কাছে প্রার্থনা করতেন। রাসূল (সা.) বিশুদ্ধ ভাষায় মার্জিত শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে কথা বলতেন। তার কথাগুলো ছিল যেন সুগন্ধি ফুল যা দিয়ে মালা গাঁথা যেত। নবী করিম (সা.) ছিলেন স্বল্পভাষি। অল্প কথায় হাজার কথার মর্ম লুকিয়ে থাকত তার ভাষণে। প্রয়োজনীয় কথা তিনি তিনবার করে বলতেন। সদা হাসি মুখে থাকতেন।
স্থানকাল পাত্রভেদে ইসলাম কঠোর ও নরম ভাষা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তুমি হক কথা বলো যদিও তা তিক্ত হয়’। ‘সুন্দর ভাষা জান্নাতে পৌঁছায় আর দুর্ব্যবহার দোযখে পতিত করে।’ সুন্দর চেহারা নয় সুন্দর ব্যবহার ও স্বচ্চরিত্র কেয়ামতে নেকির পাল্লায় ওজন বাড়াবে। ভাষাগত ক্রটি সম্পর্কে নবী করিম (সা.) নিজের জিহ্বাকে স্পর্শ করে বলেন, ‘এ জিহ্বাকেই সবচেয়ে বেশি ভয়।’তিনি আরো বলেন, ‘কিয়ামতে মানুষকে উপুড় করে দোযখে ফেলা হবে ভাষাগত অসমতার কারণে (জিহ্বার কারণে)।’ ইসলামের নামে মিথ্যে বলাও ভয়াবহ অপরাধ। সুন্দর ভঙ্গিতে ভালো ও কল্যাণকর কথা বলা সদকাতুল্য। সুমিষ্ট ভাষায় কথা বললে আল্লাহর প্রতিটি কথার বিনিময়ে সওয়াব দেবেন। মানুষের একটি বাক্যও যেন অপ্রয়োজনীয় এবং মার্জিতের মাপকাঠি অতিক্রম না করে সে দিকেও লক্ষ্য রাখতে বলা হয়েছে। বিশুদ্ধ ও সুমিষ্ট ভাষা প্রকৃত মুসলমানের নিদর্শন।

Related posts

*

*

Top