বেফাকের কাউন্সিল: প্রত্যাশা পূরণ হলো কতটুকু?

জহির উদ্দিন বাবর

Befaq-zahirbaborবাংলাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোর সবচেয়ে বড় শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার দশম কাউন্সিল ১২ ফেব্রুয়ারি সোমবার সম্পন্ন হয়েছে। পাঁচ বছর পর এই কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও কিছুটা দেরিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাউন্সিলে ১১৬ সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। সভাপতি হিসেবে অবিসংবাদিত মুরব্বি আল্লামা শাহ আহমদ শফী দা.বা. পুনরায় নির্বাচিত হবেন সেটা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ ছিল না। মহাসচিব পদেও মাওলানা আবদুল কুদ্দুস সাহেব ‘ভারমুক্ত’ হবেন এটাও প্রায় নিশ্চিত ছিল। তবে সবার কৌতূহল ছিল পরবর্তী পদগুলোর ব্যাপারে। কে নতুন যোগ হচ্ছেন, আর বাদ পড়ছেন কে সেটা নিয়ে ভেতরে ভেতরে অনেক গুঞ্জন ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এই কাউন্সিল নিয়ে ছিল উত্তাপ। অনেকে তাদের প্রত্যাশার কথা ফেসবুকে প্রচার করেছেন। যাদের কাউন্সিলে থাকার সুযোগ হবে না তারা ফেসবুকেই বলেছেন মনের কথাগুলো। বেফাকের প্রতি তাদের প্রত্যাশাগুলো অনেকে বড় করে উপস্থাপন করেছেন।

বেফাক একটি শিক্ষাবোর্ড হলেও গতানুগতিক কোনো বোর্ড নয়। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ কওমি মাদরাসা এই বোর্ডের অধীনে। দল-মত নির্বিশেষে শীর্ষ আলেমদের প্রায় সবাই আছেন এই বোর্ডের সঙ্গে। এজন্য বেফাক ঐক্যের বড় একটি প্লাটফর্ম। বাইরে নানা দল-উপদলে বিভক্ত হলেও আলেমরা এই ব্যানারটির নিচে এসে বসেন। রাজনৈতিক বা ফেরকার দিক থেকে চরম বৈরী অনেকের সঙ্গেও এই ব্যানারে সবাই জড়ো হন। এজন্য বেফাক প্রায়ই এমন জায়গায়ও ভূমিকা রাখে যেখানে সাধারণত কোনো শিক্ষাবোর্ডের ভূমিকা রাখার কথা নয়। বিভাজিত ও খণ্ডিত হতে হতে আমাদের অবস্থা যখন শোচনীয় তখনও বেফাক সবার আশা ও নির্ভরতার প্রতীক। আর এজন্যই বেফাকের প্রতি প্রত্যাশার পারদও স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি।

সরকার, প্রশাসন থেকে শুরু করে সবখানেই বেফাক অন্যরকম গুরুত্ব পায়। কওমি সনদের স্বীকৃতির জন্য আরও পাঁচটি বোর্ডের সমন্বয়ে আল হাইয়্যাতুল উলয়া নামে যে কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে সেখানেও বেফাকের ব্যাপক আধিপত্য। স্বাভাবিকভাবেই দেশের লাখ লাখ আলেম-ওলামার কাছে বেফাকের স্থান অনন্য উচ্চতায়। যার অবস্থান যত উপরে তার প্রতি প্রত্যাশাও তত বেশি। এজন্য বেফাকের সঙ্গে যারা সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয় তারাও জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে নানা সময় নানা মত দিয়ে থাকেন। এতে বেফাক সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ হয়ত ক্ষুব্ধ হতে পারেন। প্রশ্ন তুলতে পারেন, আপনি বলার কে? কিন্তু তাদের জানা উচিত, বেফাক কারও পৈত্রিক সংগঠন বা সংস্থা নয়। আকাবিরের হাতে গড়া এই বৃহত্তম প্লাটফর্মটি এই পর্যন্ত এসেছে সবার সম্মিলিত চেষ্টায়।

দুই.

গতকালের কাউন্সিলে প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাহ্যিকভাবে কাউন্সিল সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। উপস্থিতি আশানুরূপ না হলেও মোটামুটি চলনসই ছিল। কাউন্সিলে কমিটি গঠন ছাড়াও কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিশেষ করে কাফিয়া জামাত ও ইফতা বিভাগের পরীক্ষা বেফাকের অধীনে হওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে। বিষয়গুলো ভালো এবং সবখানে প্রশংসিত হয়েছে। এতবড় কাউন্সিল বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি হতেই পারে, সেটা বড় কোনো বিষয় নয়।

সারাদেশের মাদরাসাগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি চাইলেও সবার মনমতো করা সম্ভব নয়। তবে এবারের কমিটি গঠন নিয়ে এমন কিছু প্রশ্ন উঠেছে যা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সারাদেশ থেকে কাউন্সিলররা ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে যোগ দিলেও সেখানে তাদের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। অনেকটা তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত পাঠ করে শুনিয়ে দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলে মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার যে বিধান আছে তা অনেকাংশে এখানে মানা হয়নি। পুরো কাউন্সিলটি একটি বলয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের।

নতুন কমিটিতে শীর্ষ পর্যায়ে যারা স্থান পেয়েছেন তাদের অনেকে দীর্ঘদিন ধরে বেফাককে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বুজুর্গি, যোগ্যতা ও আন্তরিকতায় তারা প্রশ্নাতীত। যুবক ও উদ্যমী কিছু সদস্যের নতুন করে যুক্ত হওয়ার বিষয়টিও প্রশংসনীয়। তবে কমিটিতে কিছু কিছু লোকের স্থান পাওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে আছে তুমুল বিতর্ক। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যারা আছেন তারা তাদের ছেলে, জামাতা, ভগ্নিপতি, দুলাভাইসহ নিকটাত্মীয়দের কমিটিতে ঢুকিয়েছেন অনেকটা বিধি লঙ্ঘন করে। অনেকে হয়ত যোগ্য হিসেবেই ঢুকেছেন, তবুও প্রশ্ন তোলার মতো যথেষ্ট সুযোগ রয়ে গেছে।

সূত্রে জানা গেছে, পদগুলো ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মূলত আগের দিনই। যারা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন তারা প্রভাব খাটিয়ে নিজের দল, বলয়, গোষ্ঠী বা আত্মীয়-স্বজনকে ঢুকিয়েছেন প্রস্তাবিত কমিটিতে। সেটা নিয়ে বাদানুবাদ হয়েছে, চলেছে কূটনীতি। কে তার বলয়ের কতজনকে কমিটিতে ঢোকাতে পারে সেটা নিয়ে হয়েছে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। যারা কোনো বলয়ের না, যাদের কোনো নিকটাত্মীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নেই, তারা যত যোগ্যই হোন এই কমিটিতে স্থান পাননি।

বেফাকের আগের কমিটিতে মাদরাসার সংখ্যা হিসেবে আনুপাতিক হারে এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি বাছাই করা হতো। এবারের কাউন্সিলে সেটা মানা হয়নি। একটি বিশেষ অঞ্চলকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে রয়েছে অভিযোগ। কোনো কোনো এলাকার সঙ্গে করা হয়েছে বিমাতাসুলভ আচরণ। আমাদের দেশটি এমনিতেই ছোট, এখানে আঞ্চলিকতা টেনে আনা দুর্ভাগ্যজনক। আর ইসলাম কখনও আঞ্চলিকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। ইসলামের প্রতিনিধিত্বকারী আলেম-ওলামা আঞ্চলিকতার মতো একটি নিকৃষ্ট বিষয়কে ধারণ করবেন সেটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।

কাউন্সিলের কার্যক্রম দেখে অনেকে শুরু থেকেই ছিলেন ক্ষুব্ধ। দীর্ঘদিন ধরে বেফাকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন এমন একজন শীর্ষ আলেম ঘোষণা দিয়ে প্রতিবাদস্বরূপ কাউন্সিল বর্জন করেছেন। অনেক কাউন্সিলর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাইলেও সেই সুযোগ সেখানে ছিল না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেকে যে প্রত্যাশা নিয়ে কাউন্সিলে এসেছিলেন তাদের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বললেই চলে। তবে তারা আশাবাদী, বেফাকের কমিটি নির্বাচন প্রক্রিয়া যত বিতর্কিতই হোক আগামী দিনের কাজগুলো যেন বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকে। যদিও তাদের সেই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে সেটা সময়ই বলে দেবে।

 

Related posts

*

*

Top