ভারতীয় মুসলিমদের ভাগ্যাকাশে বিপদের ঘনঘটা

জহির উদ্দিন বাবর
গত এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাশের দেশ ভারতে অনুষ্ঠিত হলো ১৯তম লোকসভা নির্বাচন। বিশে^র সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক এই দেশটিতে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সাত দফায় এই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৩ মে একযোগে ঘোষণা করা হয় ফলাফল। এই ফলাফলে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ও তাদের জোট। তারা এতোটা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে যা মোটামুটি সবার কাছে ছিল অকল্পনীয়। ভোটে জোট হতে না পারলেও ফলাফলের আগে বিরোধী প্রায় সব দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তবে মোদির বিজয়রথ থামানো সম্ভব হয়নি। দোর্দ- প্রতাপ নিয়ে নরেন্দ্র মোদি বিশাল এই ভূখ-টি আরও পাঁচ বছর শাসন করার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছেন।

ভারতের সঙ্গে আমাদের নানা সম্পর্ক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এজন্য দেশটির উত্থান-পতন সবকিছু আমাদেরকে ছুঁয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে সেই দেশে কারা সরকারে আসছে আর কারা যাচ্ছে এটা নিয়েও আমাদের দেশের মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এমনকি নিজ দেশে ভোট দিতে না পারা, মহা বিতর্কিত নির্বাচন এসব নিয়ে চরম অতিষ্ঠ মানুষেরা এবার ভারতের নির্বাচন নিয়ে একটু বেশিই কৌতূহলী ছিলেন। তবে কট্টর হিন্দুত্ববাদী শাসক মোদির ফিরে আসায় অনেকের সেই কৌতূহলে যথেষ্ট ভাটা পড়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই ভারতের প্রাচীন দল কংগ্রেসের প্রতি এদেশের মানুষের সমর্থন বেশি। কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকার নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। তাছাড়া মুসলিমদের প্রতি তাদের আচরণ অপেক্ষাকৃত সদয় হওয়ায় এই দলটি ভারতবর্ষের ক্ষমতায় থাকুক সেটা সবাই প্রত্যাশা করে। যদিও ২০১৪ সালে সারা বিশে^র চাওয়াকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচনের ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করে দিয়ে কংগ্রেস এদেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা অনেকটা হারিয়েছে। তবে ভারতের মুসলমানদের কথা বিবেচনা করে সবার প্রত্যাশা ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট যেন ক্ষমতায় আসে। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে মুসলমানদের বিশেষ কোনো সুবিধা না হলেও অন্তত বড় কোনো ক্ষতি হবে না এমনটা সবাই মনে করে।

মোদির নেতৃত্বে বিজেপি আবার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসায় সবচেয়ে আতঙ্কে আছে দেশটির মুসলমানেরা। ভারতের মোট জনসংখ্যার তুলনায় সেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু। তবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ মুসলমানের বসবাস ভারতে। প্রায় হাজার বছর দেশটি শাসন করেছেন মুসলিম শাসকেরা। কালক্রমে মুসলিম সম্প্রদায় শাসকের সেই ঐতিহ্য হারিয়ে এখন শাসিত ও শোষিত জাতিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে একটি বৈরী সরকার ক্ষমতায় থাকলে নিজের অস্তিত্ব নিয়েই টানাপোড়েনে পড়েন মুসলমানরা। মোদি শাসনামলে বিগত পাঁচ বছর ভারতবর্ষের মুসলমানরা যে ভালো ছিল না সেটার প্রমাণ আমরা অহরহ পেয়েছি। হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরা বিজেপি এবার মুসলমানদের জীবনকে কতটা দুর্বিষহ করে তোলে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। ক্ষমতায় ফেরার কয়েক দিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা সেই আশঙ্কা আরও অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদির অতীত ইতিহাস খুবই ক্লেদাক্ত। তিনি কয়েক দফা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ২০০২ সালে তিনি যখন সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী তখন দাঙ্গা লাগিয়ে উগ্র হিন্দুরা হাজার হাজার মুসলমানকে কচুকাটা করেছে। জ¦ালিয়ে দিয়েছে শত শত মসজিদ। লাখ লাখ মুসলমানকে ঘরবাড়ি ছাড়া করা হয়েছে। সেই ঘটনা ছিল নরেন্দ্র মোদির প্রত্যক্ষ ইঙ্গিতে। তখন তাকে ‘গুজরাটের কসাই’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। সেই মোদিই ভাগ্যের জোরে ২০১৪ সালে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। তার মতো একজন উগ্র ও সংকীর্ণমনা নেতাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো ভারতের সোয়াশ কোটি জনগণের জন্য ছিল চরম লজ্জার।

ক্ষমতায় আসার আগে মোদি ভারতের আর্তসামাজিক অবস্থা পাল্টে দেয়ার মতো বড় বড় স্লোগান দিলেও বিগত পাঁচ বছরে তেমন কিছুই করতে পারেনি। বিগত দিনে তার কর্মকাণ্ডের কারণে জনগণ ছিল তার প্রতি ক্ষ্যাপা। এবার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য ইস্যু খুঁজছিলেন মোদি। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ভারত নিয়ন্ত্রণাধীন জম্মু-কাশ্মিরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় দেশটির ৪৮ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হন। এ ঘটনার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানকে দায়ী করে মোদি এটাকে কৌশলে ইস্যু বানিয়ে নেন। এই ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আকাশসীমা লঙ্ঘন করে পাকিস্তানের বালাকোটে গিয়ে বোমা হামলা চালায় ভারত। ফাঁকা মাঠে বোমা হামলা চালালেও মোদি সরকারের দাবি পাকিস্তানের কথিত ৩০০ জঙ্গি এই হামলায় নিহত হয়েছে। যদিও কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই দাবির পক্ষে কোনো আলামত খুঁজে পায়নি।

তবে এর মধ্য দিয়ে মোদি তার নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার ইস্যু পেয়ে যান। সস্তা আবেগকে কাজে লাগিয়ে দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য তাকে যে কতটা দরকার সেটা তিনি বাকপটুতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হন। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠী মোদির এই টনিক খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করে। পাকিস্তান আর মুসলমানদের ঘায়েল করা কিংবা তাদেরকে দমিয়ে রাখার জন্য মোদির বিকল্প হিসেবে তারা কাউকে খুঁজে পাননি। তীব্র হিন্দুত্ববাদ তাদের ভেতরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উপরে উপরে তারা ধর্মীয় সহাবস্থান আর ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও ভেতরে ভেতরে চরম মুসলিম বিদ্বেষ লালন করেন। মূলত তাদের সেই মুসলিম বিদ্বেষ থেকেই মোদিকে দুই হাত উজাড় করে সমর্থন দিয়ে নজিরবিহীনভাবে নির্বাচিত করে। অথচ মোদি সরকারের পাঁচ বছরের কর্মকা- বিশ্লেষণ করলে কোনোভাবেই তাদের পুনরায় ক্ষমতায় ফেরার কথা ছিল না।

ভারতে মুসলমানদের ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে মোদি আর অমিত শাহর নেতৃত্বাধীন বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এর মাত্রা বেড়ে গেছে বহুগুণে। এক গরুর মাংস ইস্যুতেই তারা মুসলমানদের ওপর অবর্ণনীয় নিপীড়ন চালিয়েছে। ফ্রিজে গরুর মাংস আছে এমনটা সন্দেহ করে বাড়ি থেকে ডেকে এনে পিটিয়ে হত্যার মতো জঘন্য বর্বরতার ঘটনা তারা ঘটিয়েছে অহরহ। বিজেপির সহযোগী আরএসএস কিংবা শিবসেনা এ জাতীয় সংগঠনগুলো গত পাঁচ বছর মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর অবর্ণনীয় নিপীড়ন চালিয়েছে। সর্বোপরি ভারতকে মুসলিমশূন্য করার ঘোষণা তারা প্রকাশ্যেই দিয়েছে। ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে তারা বিভিন্ন রাজ্য থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করার মতো প্রক্রিয়াও ইতোমধ্যে শুরু করেছে। এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জির নামে তারা মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের জীবনকে চরম হুমকির মুখে ফেলেছে। গত বছর আসামে তারা এই প্রক্রিয়া শুরুও করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও এই প্রক্রিয়া শুরুর করার চেষ্টা করছে। পুনরায় বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার পর গুজরাটের কসাই খ্যাত মোদির জন্য সেটা বাস্তবায়ন করা অনেক সহজ হয়ে গেল।

কল্পনার চেয়েও বেশি সমর্থন নিয়ে মোদির ক্ষমতায় ফেরায় ভারতীয় মুসলমানরা চরমভাবে উদ্বিগ্ন। বহুকাল ধরে এখানকার মুসলমানরা যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে আসছে এর অনেকগুলো কেড়ে নেয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কংগ্রেসসহ বিরোধী দলগুলো যাদের কিছুটা হলেও আনুকূল্য পায় মুসলমানরা সেই দলগুলোর অবস্থাও করুণ। নির্বাচনের আগে বিরোধী দলগুলোর বৃহত্তর ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। তাদের ধারণা ছিল বিচ্ছিন্নভাবে নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়ার পর সরকার গঠন করতে ঐক্যের প্রয়োজন হলে তা করা যাবে। কিন্তু মোদির তথাকথিত ম্যাজিকের কাছে তাদের সব পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তারা এখন মুসলমানদের পাশে দাঁড়াবে কী, নিজেরাই অস্তিত্ব সংকটে।

ভারতের মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে যখন বিপদের ঘনঘটা তখন স্বাভাবিকভাবেই পাশের দেশ হিসেবে আমাদেরকে প্রচ- উদ্বিগ্ন করে। নাগরিকপঞ্জির নামে লাখ লাখ মুসলমানকে তাড়িয়ে দেয়ার পাঁয়তারা করছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা। আমাদের নতজানু নীতির কারণে তারা এই সুযোগটা পেয়ে গেলে জাতীয়ভাবে আমাদের চরম মাশুল দিতে হতে পারে। ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপ সামলাতে যখন আমরা হিমশিম খাচ্ছি তখন আরও কয়েক লাখ ভারতীয় মুসলিমকে জোর করে পুশ-ইন করে দিলে চরম সংকটে পড়তে হতে পারে আমাদের। এজন্য আমাদের সরকারকে এ ব্যাপারে আগে থেকেই সজাগ থাকতে হবে। দেশীয় ইস্যুতে সরকারের প্রতি আমাদের যত ক্ষোভ আর অনুযোগই থাকুক অন্তত এ ধরনের ইস্যুতে জাতীয় ঐকমত্য দরকার। মোদি দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পরপরই মুসলিমবিদ্বেষের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। এজন্য আসুন আমরা আল্লাহর দরবারে দোয়া করি তিনি যেন ভারতীয় মুসলিম হেফাজত করেন। হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে টিকে থাকা ভারতীয় মুসলিমদের আগামী যেন হয় মসৃণ ও নিরাপদ।

Related posts

*

*

Top