যাঁর হৃদয়ের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়

জহির উদ্দিন বাবর
Ijtema_zahirbabor (2)‘তাবলিগ জামাত’ নামটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যে মহান মনীষীর কথা আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে তিনি হলেন হযরতজী মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস রহ.। তাবলিগের কার্যক্রম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে তাঁর ইখলাস, লিল্লাহিয়াত, সাধনা ও চোখের পানিই সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর অন্তরে দীনের যে জ্বলন ছিল তা ছড়িয়ে পড়ে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে। এভাবেই তাবলিগ নামক নববী ধারার দাওয়াতী আন্দোলন জয় করে নিয়েছে সারা দুনিয়া। খালেস দীনী ধারার এ দাওয়াতী কার্যক্রম যতদিন থাকবে ততদিন এর সঙ্গে মিশে থাকবে হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর নাম। তাঁর জন্ম ১৩০৩ হিজরি মোতাবেক ১৮৮৪ সালে। তাঁর বংশধররা ছিলেন দিল্লীর ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের অগ্রসেনানী। পৃথিবীর আলো-হাওয়ায় চোখ খুলেই তিনি এমন একটি অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিলেন যাতে তাঁর বেড়ে ওঠাটা হয়েছিল স্বাচ্ছন্দ্যময়। আখলাকটা গড়ে ওঠেছিল পারিবারিক ঐতিহ্যে। গুণ ও বৈশিষ্ট্যে তিনি পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গিয়েছিলেন।

তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি মানবপ্রেমী পিতা মাওলানা ইসমাঈল রহ. এর হাতে। প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন নিজ গ্রাম কান্ধালাতে। ১৩১৪ হিজরিতে বড় ভাইয়ের সঙ্গে গঙ্গুহতে গমন করেন। তৎকালীন গঙ্গুহ ছিল আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পুণ্যভূমি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ইলিয়াস রহ. ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনিতেই ছিলেন শীর্ণকায়, দুর্বল প্রকৃতির; অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। পড়াশোনার গতিও কিছুটা থেমে যায়। প্রায় সাত বছরের টানা চিকিৎসায় তিনি আরোগ্য লাভ করেন। ১৩২৬ হিজরিতে তিনি দাওরায়ে হাদীস বা হাদীসশাস্ত্রের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন।

কর্মজীবন শুরু হয় ১৩২৮ হিজরিতে, সাহারানপুর মাজাহিরুল উলূম মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। একাধারে আট বছর তিনি দীনের ইলম বিতরণে কাজ করেন। পিতা ও ভাইয়ের ইন্তেকালের পর  মেওয়াতবাসী তাঁকে অনুরোধ জানান মেওয়াতে ফিরে যেতে। এলাকার লোকদের অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। চলে এলেন মেওয়াতে। দীনী শিক্ষা প্রসারে কাজ করে যেতে থাকলেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। শিক্ষা-দীক্ষা ও সভ্যতা-সংস্কৃতিতে মেওয়াতীরা ছিল অনেক পিছিয়ে। প্রাচীন আরব  বেদুঈনদের সঙ্গে তৎকালীন মেওয়াতীদের তুলনা করলে যথার্থ হবে। তারা বংশসূত্রে মুসলমান ছিল, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ইসলামের কোনো চিহ্ন তাদের মধ্যে ছিল না। এমনকি নামে পর্যন্ত তাদের স্বকীয়তা বিলীন হয়ে গিয়েছিল হিন্দুদের মাঝে। হিন্দুদের কিছু পূজা-পার্বণও তারা নিয়মিত পালন করত। তাঁর পিতার চালুকৃত মক্তবটিকে কেন্দ্র করেই ইলিয়াস রহ. শিক্ষার আলো ছড়ানোর চেষ্টা চালান। এলাকার লোকদের কাছ থেকে শিশুদের চেয়ে আনেন। নিজের পয়সায় শিক্ষক নিয়োগ করেন। এভাবে বেশকিছু মক্তব চালু হয়।
মক্তব প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর কর্মসূচির প্রথম ধাপ। তিনি মেওয়াতবাসীর করুণ অবস্থা দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন কীভাবে তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো যায়। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কিংবা ইলহামিভাবে তিনি সে পন্থার সন্ধান লাভ করলেন। তিনি ভাবলেন, লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে এমন কর্মপন্থা অবলম্বন করা দরকার যে পন্থা চালু ছিল সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে। সে পন্থাটি ছিল ইখলাস ও আত্মনিবেদন। প্রথম জামানার মুজাহিদ বাহিনীও কোনো বেতন ছাড়াই নিজের খাদ্য ও নিজ সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জিহাদের ময়দানে গমন করতেন। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের অবৈতনিক স্বেচ্ছাসেবক ও মুজাহিদ সৃষ্টি না হবে ততক্ষণ সর্বসাধারণের মধ্যে দীনের তলব সৃষ্টি হবে না। তিনি তাঁর এই  চিন্তাধারাকে একটা আন্দোলনের রূপ দিলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর দরদমাখা আহবান। বিশ্ব তাবলিগ জামাতের  গোড়াপত্তন হলো। ইলিয়াস রহ. এর পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁর মতো দরদী কিছু আলেম। দরদ ও চেতনার সেই স্পৃহা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল দিক-বিদিক। দীনী আন্দোলনের সেই আলোকশিখায় পাক-ভারত উপমহাদেশ পেরিয়ে আজ বিস্তৃত ভুবনময়।

Ijtema_zahirbabor (1)জরতজী ইলিয়াস রহ. তাঁর দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে মানুষকে কী দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে এতবড় বিপ্লব সাধন করেছিল? তা ছিল পরকালের স্মরণ, আল্লাহর সাহায্যের ওপর পূর্ণ আস্থা ও দৃঢ়বিশ্বাস। তিনি মানুষের অন্তরে এ বাস্তব সত্যকে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করে দিতে পেরেছিলেন যে, এই সৃষ্টি জগতের একজন মালিক রয়েছেন। আর তাঁর কাছেই আমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে। সৃষ্টি জগতের কোনো অণু-পরমাণুই তার ইচ্ছার বাইরে নড়াচড়া করতে পারে না। যা কিছু হয় তার হুকুমেই হয়। তিনি এ মহত কাজকে রাসূলুল্লাহ সা.-এর তরিকা ও আদর্শ জীবিত করার মেহনত নামে আখ্যায়িত করতে পছন্দ করতেন এবং এধরনের শব্দাবলী ও পরিভাষার মাধ্যমে তা ব্যক্ত করতেন। তাঁর মূল স্লোগানই ছিল ‘অ্যাই মুসলমানো! মুসলমান বনো!’ (হে মুসলমানরা! মুসলমান হও।)

হজরতজী মাওলানা ইলিয়াস রহ. বংশীয় সূত্রেই মানবতাবাদী ও দরদী একটা অন্তর লাভ করেছিলেন। মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হওয়া এবং মানুষের কল্যাণ সাধনই ছিল তাঁর জীবনের মহানব্রত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের মূল শিক্ষাও মানবতাস্পর্শক। অকৃত্রিম দরদ, অক্লান্ত সাধনা, সর্বোপরি ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের পরাকাষ্ঠার কারণেই তাবলিগ জামাত আজ মানুষের হৃদয়রাজ্য জয় করেছে। মানুষের মূল গন্তব্য ও অনিবার্য পরিণতি সম্পর্কে সতর্কতার মাধ্যমে মানবতার উত্তরণের যে প্রয়াসের সূচনা করেছিলেন তা আজো অক্ষুন্ন আছে। সমস্যাসঙ্কুল, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এই বিশ্বে সবধরনের বৈষয়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠে সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জীবনের কাক্সিক্ষত সফলতার পথে এগিয়ে চলাই তাবলিগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য নিয়েই হযরতজী ইলিয়াস রহ.-এর অন্তরের জ্বলন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।

*

*

Top