যে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের আগেই তিনি চলে গেলেন

abdullah Jahangirএতটা হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন এটা ভাবিনি। সাতসকালে ফেসবুকের নিউজ ফিডে যখন খবরটি দেখি তখন অন্তরটি মোচড় দিয়ে উঠে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। বারবার মনে মনে বলছিলাম, খবরটি মিথ্যা বা গুজব হোক। কিন্তু না, কিছুক্ষণের মধ্যে টিভি চ্যানেলগুলোর সর্বশেষ সংবাদে ভেসে উঠছে সড়ক দুর্ঘটনায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ দুজন নিহত। বেলা যত বাড়তে থাকলো ফেসবুকের নিউজ ফিড ভেসে গেল নূরানী সেই চেহারার ছবিতে; সঙ্গে হৃদয়নিংড়ানো শোকতাপ। বিশ্বাস করতে না চাইলেও মেনে নিতে হলো সবার প্রিয় ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর আর নেই। সম্প্রতি মারা যাওয়া কোনো আলেম-বুদ্ধিজীবীর জন্য সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসার এমন বহিঃপ্রকাশ আগে লক্ষ্য করিনি। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ কোনো স্মৃতি নেই; দুই তিনবারের সাক্ষাৎ আর সামান্য কথাবার্তায় তাঁর মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মানুষকে এতটা সহজে কেউ আপন করে নিতে পারে এটা তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না।
গত রমজানের পরপর সৌদি প্রবাসী প্রিয় আহমাদুল্লাহ ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন মাদরাসা দারুর রাশাদে। আমাদের দুজনেরই সাবেক কর্মস্থল এই দারুর রাশাদ। এখানে আসবেন আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেব। ব্যবস্থা করেছেন আহমাদুল্লাহ ভাই নিজেই। এর আগে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল ইসলামবার্তার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। আহমাদুল্লাহ ভাই নাম বলে পরিচয় করিয়ে দিতেই জড়িয়ে ধরলেন, যেন কতদিনের পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা। একসঙ্গে আমরা ঘণ্টা তিনেক কাটালাম। দারুর রাশাদের মুহতামিম মাওলানা মুহাম্মদ সালমান ও শিক্ষাসচিব মাওলানা লিয়াকত আলীসহ শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে দীর্ঘ মতবিনিময় হলো। আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর সাহেব সাধারণ ও দ্বীনি ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে চাচ্ছেন, দারুর রাশাদে এসেছেন অভিজ্ঞতা নিতে।
আহমাদুল্লাহ ভাই আগেই আভাস দিয়েছিলেন, তাঁর একটি সাক্ষাৎকার যেন নেয়া হয়। আমি কয়েকটি প্রশ্ন প্রস্তুতও করে রাখি। এক ফাঁকে সাক্ষাৎকারের বিষয়টি বলতেই তিনি কোনো ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই বললেন, ঠিক আছে আমি প্রস্তুত। শিক্ষা, মিডিয়া, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গসহ নানা বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করলাম। অনর্গল তিনি জবাব দিয়ে গেলেন। তাঁর চিন্তার গভীরতা, ভারসাম্যতা, কথা বলার ধরণ ও মিষ্টতা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে রাখলো। একটি অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে পুরোটা রেকর্ড করলাম। ইচ্ছা ছিল অনুলিখন করে কোথাও প্রকাশ করবো। কিন্তু অলসতা আর ব্যস্ততার কারণে অনেক দিন পর্যন্ত সেই কাজটি আর করা হয়নি। দুর্ভাগ্য ও আফসোসের বিষয় হলো, সেই মোবাইল সেটটি কিছুদিন পর অকেজো হয়ে পড়লো। সেখান থেকে সাক্ষাৎকারটি আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ভাবছিলাম, কোথাও আবার তাঁর সঙ্গে বসবো এবং কিছু প্রশ্ন করবো। কিন্তু সেই সুযোগ আর কখনও হবে না।
হারিয়ে যাওয়া সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সম্পর্কে আলোকপাত করেন। ত্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা কিভাবে জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সেটা নিয়ে কথা বলেন। সময়ের প্রয়োজনে সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। মিডিয়া সম্পর্কে আলেম-ওলামার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার পক্ষে মত দেন। যোগ্য ও ইলমি লোকদের টেলিভিশনে যাওয়ার ব্যাপারে তাগিদ করেন। বিশুদ্ধ আকিদার লোকেরা মিডিয়ায় না গেলে সেখানে বিদআতি ও ভ্রান্ত আকিদার লোকেরা দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করবে বলেও সতর্ক করেন। জাকির নায়েক বিতর্কের এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান পেশ করেন, যা আলেমদের ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে। তিনি বলেন, জাকির নায়েক সাহেব তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে থাকলেই ভালো, ফিকহি বিষয়াদিতে তার জড়ানো সমীচীন নয়। পিস টিভির আলোচক হওয়া সত্ত্বেও অনায়াসে কিছু বিষয়ে জাকির নায়েকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। বাংলাদেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখের বৃহত্তর ঐক্যের ব্যাপারে জোরালো তাগিদ করেন। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর শ্বশুর ফুরফুরার পীর সাহেবের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ঐক্যপ্রচেষ্টার উদাহরণ তুলে ধরেন।
দারুর রাশাদ থেকে নিজের গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে গেলেন দারুর সালাম মাদরাসায়। সেখানে তিনি হাদিস পড়াতেন, প্রতি সপ্তাহে ঝিনাইদহ থেকে আসতেন। গাড়িতে বসে একবার ঝিনাইদহে যাওয়ার এবং তাঁর আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট ও এর কার্যক্রম দেখার আমন্ত্রণ জানান। বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরামের দুটি স্মারক তাঁকে দেয়া হয়। আমাদের কার্যক্রম দেখে অসম্ভব খুশি হন। এ  ধরনের কাজে তিনি যেকোনো ধরনের সহযোগিতায় প্রস্তুত বলেও জানান। আমাদের একটি অনুষ্ঠানে থাকার ব্যাপারে আগ্রহও দেখান। আমি অনলাইন পত্রিকায় কাজ করি শুনে এ ব্যাপারে নানা খোঁজ-খবর নেন। একটি সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে তিনি ফোনেও এ ব্যাপারে কথা বলেন। অনলাইন পত্রিকা করার ব্যাপারে সুবিধামতো একদিন বসে আলোচনা করবেন সেটাও জানান। গত বছরের ১৫ আগস্টে বাংলামোটরে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হয়। আহমাদুল্লাহ সাহেবের আয়োজনে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সাইফুল ভাইয়ের অফিসে সেই অনুষ্ঠানে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
তিনি দূরে থাকলেও সবার কাছে ছিলেন। মিডিয়ায় তাঁর নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। টেলিভিশনে অনেকেই কথা বলেন, কিন্তু তাঁর মতো এতো ভারসাম্যপূর্ণ কথা আর কারও কাছ থেকে শুনিনি। কোনো কোনো চ্যানেলে তিনি সরাসরি প্রশ্নোত্তর দিতেন। জটিল জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতেন অতি সহজ করে, কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি ছাড়া। তাঁর আলোচনার সময় আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম একজন দা’য়ীর বাচনভঙ্গি এমনটাই হওয়ায় উচিত। সব ধরনের, সব মত-পথের মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় কেউ কেউ তাঁকে ভুল বুঝতো। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর সবার এটা অনুভব হচ্ছে, এই শূন্যতা হয়ত আর পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন-সেটাই সবার প্রত্যাশা।

*

*

Top