ইসলামি প্রকাশনা: যেতে হবে আরও বহুদূর

জহির উদ্দিন বাবর
Islami-prokasona_zahirbabor.comবাংলাদেশে ইসলামি ধারার প্রকাশনা শিল্পের বিকাশটা খুব বেশি দিন আগের নয়। একটা সময় ছিল ইসলামি প্রকাশনা বলতে ‘মকসুদুল মুমিনিন’ আর ‘বারো চান্দের ফজিলত’ এসব বইকেই মনে করা হতো। সবার ঘরে ঘরে এই ধরনের দুই একটা বই থাকত। ইসলাম সম্পর্কে জানার জন্য বিশুদ্ধ আকিদার পঠনপাঠন সামগ্রীর অভাব ছিল প্রকট। সম্ভবত ছদর সাহেব খ্যাত মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. সর্বপ্রথম বেহেশতি জেওর এবং এই ধরনের আরও কিছু অনুবাদ ও মৌলিক বই জাতিকে উপহার দেন। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে তাঁর বইগুলোই ছিল হক্কানি ধারার আলেমদের লিখিত প্রধান ইসলামি প্রকাশনা। পরবর্তী সময়ে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ. ইসলামি প্রকাশনা জগতে বড় একটি ভূমিকা রাখেন। এছাড়া এক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের আলেমরা লিখনি জগতের প্রতি ততটা মনোযোগ দিতে পারেননি। বিগত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে আলেমদের মধ্যে এক্ষেত্রে একটা বড় জাগরণ সৃষ্টি হয়। সেই সময়ের তরুণ আলেমদের একটি বড় অংশ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং লেখালেখির দিকে বিশেষ মনোযোগ দেন। তাদের অবদানেই মূলত ইসলামি ধারার প্রকাশনা পায় নতুন মাত্রা। গত ২০ বছরে ইসলামি ধারার প্রকাশনা যে জায়গায় উন্নীত হয়েছে তা গত কয়েকশ বছরেও হয়নি। এই সময়ে যে হারে আলেম লেখক তৈরি হয়েছেন তা আরও কখনও হয়নি। নিঃসন্দেহে ইসলামি প্রকাশনার ক্ষেত্রে গত দুটি দশক একটি স্বর্ণোজ্জ্বল সময়।

ইসলামি প্রকাশনার জগৎ এখন অনেক সমৃদ্ধ। বাংলাবাজারে ইসলামি টাওয়ারের পুরোটা জুড়েই ইসলামি প্রকাশনা। এখানে আছে কয়েকশ প্রকাশনী। প্রতি মাসে এখান থেকে প্রকাশিত হচ্ছে কয়েকশ বই। বছর শেষে ইসলামি বইয়ের প্রকাশনার সংখ্যাটা যে জায়গায় দাঁড়ায় তা সাধারণ ধারার বইপত্রের চেয়ে বেশি। কারণ আমাদের দেশে সাধারণ ধারার বইপত্র সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়। মাস শেষে বাংলা একাডেমি থেকে যে হিসাব দেয়া হয় তাতে সর্বমোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার হাজারের বেশি নয়। সাধারণ ধারার প্রকাশনীগুলো সারা বছর সাধারণত তেমন কোনো বইপত্র ছাপে না। এ হিসেবে আমাদের ইসলামি ধারার প্রকাশনীগুলো সারা বছরই কমবেশি বই ছাপে। এজন্য মোট সংখ্যার বিচারে সাধারণ ধারার বইপত্রের চেয়ে ইসলামি ধারার বই বেশি প্রকাশিত হচ্ছে।

ইসলামি ধারার বইয়ের পাঠকও বেশি। সারা বছরই ইসলামি বইপত্র কমবেশি বিক্রি হয়। বিশেষ করে রমজানে প্রচুর বই বিক্রি হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে, যেখানে বাংলাবাজারের বইগুলো নিয়মিত সরবরাহ করা হয়। এতে পাঠকেরা হাতের নাগালেই পাচ্ছে ইসলামি বই। তাছাড়া রকমারি ডটকমের মতো বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমেও ঘরে বসে ইসলামি বইপত্র যোগাড় করা যাচ্ছে। দিন দিন মানুষের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ছে। তাদের কৌতূহল মেটানোর মতো বইপত্রও প্রকাশিত হচ্ছে। ইসলামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সাধারণ ধারার বইপত্রের চেয়ে তাদের বিক্রি কোনো অংশেই কম নয়। সবমিলিয়েই বলা যায়, ইসলামি প্রকাশনা জগৎ এখন অনেক সমৃদ্ধ এবং সাধারণ ধারার প্রকাশনার সঙ্গে অন্তত সংখ্যায় পাল্লা দেয়ার অবস্থানে আছে।

দুই.
Zahirbabor 1ইসলামি ধারার প্রকাশনা সংখ্যার বিচারে একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে সত্য, কিন্তু মানের বিচারে এখনও অনেকটা পিছিয়ে সেটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। এই অঙ্গনের শূন্যতা পূরণের জন্য একটা সময় আমাদের পূর্বসূরিরা শুধু পঠন-পাঠন সামগ্রীর পরিমাণ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। তাদের প্রচেষ্টার ফলে পরিমাণের দিক থেকে আমরা একটি তৃপ্তিবোধের জায়গায় অবস্থান করছি। এখন আমাদেরকে জোর দেয়া দরকার মানের দিকে। প্রতি মাসে বা বছরে ইসলামি ধারার কতটা বই প্রকাশিত হচ্ছে সেই জায়গাটিতে তৃপ্ত না থেকে এখন মনোযোগ বাড়াতে হবে মানসম্পন্ন বই কতটা প্রকাশিত হলো। মানের বিচারে সাধারণ ধারার বইপত্রের সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন ইসলামি প্রকাশনার দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

আমাদের ইসলামি ধারার প্রকাশনার বড় অংশটাই অনুবাদ। এর যৌক্তিক কারণও আছে। ইসলামের মূল উৎস মূলত আরবি। সরাসরি আরবি থেকে ইসলামকে জানার মতো লোকের সংখ্যা আমাদের দেশে খুবই কম। এজন্য আরবি থেকে অনুবাদের কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু ইলমি ক্ষেত্রে পাশের দেশ ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের একটা ঐতিহ্যগত যোগসূত্রতা রয়েছে এজন্য তাদের ভাষায় অর্থাৎ উর্দুতে রচিত বইপত্রের অনুবাদ হয়েছে বেশি। আমাদের মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনার মাধ্যম আরবি ও উর্দু। এজন্য মাদরাসাপড়–য়ারা এই দুটি ভাষায় বেশ পারঙ্গম। এমনকি অনেকে মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে আরবি-উর্দুতে সাচ্ছন্দ বোধ করেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা বাংলা ভাষাভাষি পাঠকদের জন্য অনুবাদের ক্ষেত্রটি বেছে নিয়েছেন। ইসলামি পঠন-পাঠন সামগ্রীর শূন্যতাটা দ্রুত পূরণ করার জন্য এর কোনো বিকল্পও ছিল না।

তবে অনুবাদনির্ভর প্রকাশনা অনেক হয়েছে। এবার সবার একটু জোর দেয়া দরকার মৌলিকের দিকে। অনুবাদকে একদম অস্বীকার করার উপায় নেই। সাহিত্যের একটি স্বীকৃত ধারা অনুবাদ। ইসলামি ধারায় অনুবাদের গুরুত্বটা আরও বেশি। তবে সবকিছুরই একটা সীমা থাকে। আমাদের ইসলামি ধারার প্রকাশনা জগতেও অনুবাদের সীমাটা বোধহয় অতিক্রম করে যাচ্ছে। আমাদের প্রকাশকদের অনুবাদের প্রতি এতটাই আগ্রহ যে, আরবি-উর্দুতে রচিত যেকোনো মানের বই পেলেই এর অনুবাদের দিকে দৌড়ান। অথচ এর চেয়ে অনেক দরকারি ও মানসম্পন্ন মৌলিক বইপত্রের দিকেও ততটা আগ্রহ দেখান না। পরিচিত ও পুরোনো লেখকদের মৌলিক কিছু বইপত্র বের করলেও নতুন লেখকদের মৌলিক রচনায় বরাবরই প্রকাশকদের অনাগ্রহ।

এক্ষেত্রে শুধু প্রকাশকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই, দায় আছে লেখকদেরও। একজন লেখক শুরুতেই অনুবাদের দিকে দৌড়াতে থাকেন। কারণ বাংলাবাজারের প্রকাশকদের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো থাকলে মিলে কাঁচা টাকা, অর্জন করা যায় দ্রুত খ্যাতি। লেখালেখির মৌলিক যোগ্যতা অর্জিত হোক আর না হোক, অনুবাদক হিসেবে রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষে উঠে যান। ডজনের পর ডজন বই বাজারে চলে আসে, কিন্তু লেখালেখির প্রাথমিক যোগ্যতাটাও অর্জিত হয় না। অনুবাদ করতে গেলে যে শুধু আরবি-উর্দু জানলে হবে না, বিশুদ্ধ বাংলা ভাষাটাও চর্চা করতে হবে সেটাও ভাবার সময় পান না অনেকে। কাঁচা হাতের অনুবাদগুলো সম্পাদনাহীন অথবা দুর্বল সম্পাদনায় বাজারে চলে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে মান ও শ্রীহীন বইগুলো শিক্ষিত পাঠকেরা হাতেও নিতে চান না। এই ঘাটতিটুকু পূরণের জন্য লেখক-প্রকাশক উভয়কে আন্তরিক হতে হবে।

ইসলামি ধারার প্রকাশনার বেশির ভাগই বাজারে চলে আসে অসম্পাদিত অবস্থায়। সম্পাদনার জন্য বাড়তি খরচ করতে তেমন আগ্রহ দেখান না প্রকাশকরা। কোনোরকম গোঁজামিল দিয়ে বই বাজারে নিয়ে আসতে পারলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে প্রকাশক। এই অঙ্গনে যোগ্য লোকের সংকট আছে সত্য, তবে মোটামুটি মানের সম্পাদনা ছাড়া কোনো বই প্রকাশ করা উচিত নয়। বিশেষ করে ইসলামি বিষয়ে বইপত্র প্রকাশে একটু বেশিই সতর্ক থাকা চাই। ইসলামি বইপত্রের মেকাপ-গেটাপ নিয়েও আছে অসন্তোষ। এক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেকটা পরিবর্তন এলেও আরও অনেক বেশি রুচি-বৈচিত্র্যের ছাপ রাখা দরকার। সাধারণ ধারার বইপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে গায়ের মূল্য বাড়িয়ে হলেও বইয়ের উপস্থাপনাটা আরেকটু সুন্দর, সবকিছুর মানটা আরেকটু বাড়ানো দরকার।

তিন.
zahirbaborইসলামি ধারার প্রকাশকদের মধ্যে আইটেম বাড়ানোর একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। কার কত আইটেম এটা হিসাব করা হয়। এজন্য অনেক সময় আইটেম বাড়াতে গিয়ে মানের দিকটি তেমন গুরুত্ব দেয়া সম্ভব হয় না। ইসলামি ধারার প্রকাশনায় যারা প্রাথামিক পর্যায়টা পেরিয়ে এসেছেন তাদের এখন সময় এসেছে মানের দিকটিকে প্রাধান্য দেয়ার। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে এখন মানের কোনো বিকল্প নেই। নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থটা প্রাধান্য দিয়েও মানসম্পন্ন কাজ করা সম্ভব। সম্প্রতি কিছু প্রকাশনী এর নজিরও স্থাপন করেছে। লেখা, সম্পাদনা এবং ছাপা সবখানে রুচি-বৈচিত্র্যের ছাপ রেখেছে। এগুলো অন্যদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।

ইসলামি ধারার প্রকাশনা এখনও শিল্পের মর্যাদা পায়নি। সাধারণ ধারার প্রকাশকরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পান এখানে তা পাওয়া যায় না। প্রকাশকরা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করলে এটাকে একটি শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করতে পারেন। তখন এখানে বিনিয়োগ বাড়বে এবং অনেক সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যাবে। তবে এর জন্য দরকার প্রকাশকদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া। তাদের মধ্যে শক্তিশালী কোনো ইউনিটি আছে বলে জানা নেই। এজন্য প্রায়ই নৈরাজ্যের নানা খবর শোনা যায়। অনেক ক্ষেত্রে চলে নোংরামিও। নকল আর জালিয়াতির প্রতিযোগিতা তো আছেই। এজন্য শীর্ষস্থানীয় প্রকাশকদের এ ব্যাপারে এখনই ভাবতে হবে। সবাইকে নিয়ে সুন্দর পথচলা নিশ্চিত করতে হবে।

ইসলামি প্রকাশনার জগৎ অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। তাদের এই এগিয়ে চলা নিঃসন্দেহে সাফল্যের। তবে পথচলার কোনো শেষ নেই। এখনও অনেক পথ পাড়ি দেয়ার বাকি আছে। ইসলামি ধারার প্রকাশনা যখন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হবে, ইসলামকে জানার মতো মানসম্পন্ন পঠন-পাঠন সামগ্রীর যেদিন কোনো কমতি থাকবে না সেদিনই মূলত অর্জিত হবে প্রকৃত সাফল্য। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে লেখক, প্রকাশক ও পাঠক এই তিন শ্রেণির সমন্বিত প্রয়াস দরকার। সবার সহযোগিতা ছাড়া ইসলামি প্রকাশনাকে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এজন্য জাগতে হবে সবার।

Related posts

*

*

Top