এ যুগের আব্দুল্লাহ বিন সাবা’দের চিনে রাখুন

image_79589_0হামিদ মীর
মুসলমানদের আভ্যন্তরীণ ঝগড়া-ফ্যাসাদ লাগানোর ক্ষেত্রে সবসময় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে মুনাফিকরা। ওই মুনাফিকরা বেশির ভাগ সময় মুসলিম সেজে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা. মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গেলে সেখানে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা একটি মসজিদ নির্মাণ করে। ইতিহাসে সেটি ‘মসজিদে জেরার’ নামে পরিচিত। কুরআন মজিদেও মসজিদে জেরারের আলোচনা এসেছে। ওই মসজিদটি ব্যবহার করতো মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা। রাসুল সা. ওই মসজিদটি গুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রাসুল সা. ঘোষণা দিলেন প্রকৃত ঈমানদারেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে যারা চরমপন্থা অবলম্বন করে, জুলুম-নির্যাতনের পথ বেছে নেয় এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে। ওই চরিত্রের লোকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের হাত সম্মিলিতভাবে উঠবে, তারা যদি কোনো মুসলমানের সন্তান হয় তবুও। মদিনা সনদে এটাও বলা হয়েছিল, কোনো মুসলমানকে কাফেরের বদলে হত্যা করা যাবে না এবং কোনো মুমিনের বিপরীতে কাফেরকে সহযোগিতা করা যাবে না। পাকিস্তানের লেখক রফিক দোগর তার রচিত ‘আল আমিন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে মদিনা সনদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। চার খণ্ডের ওই বইটিতে নবী করিম সা.-এর জীবনী পড়ে জানা যাবে, মুনাফিকরা সব সময়ই মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে। রাসুল সা.-এর ইন্তেকালের পর তাদের ওই ষড়যন্ত্র আরো বেড়ে যায়।

মিশরের পণ্ডিত ড. তোয়াহা হোসাইন হজরত ওসমান গনি ও হজরত আলি রা.-এর আলাদা আলাদা জীবনী রচনা করেছেন। এতে তিনি সম্মানিত দুই সাহাবির বিরুদ্ধে মুনাফিকদের অব্যাহত ষড়যন্ত্রের কথা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। ড. তোয়াহা হোসাইন মুসলমানদের পরস্পরে সংঘটিত দুটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ ‘জামাল’ ও ‘সিফফিনে’র চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। ‘জঙ্গে জামাল’ হয়েছিল হজরত ওসমান রা.-এর ইন্তেকালের পর; হজরত আলী রা. ও হজরত আয়েশা রা.-এর অনুসারীদের মধ্যে। ইরাকের কুফা ও বসরায় একটি গ্রুপ ঘোষণা করে দিল, যতক্ষণ হজরত ওসমান রা.-এর হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ নতুন খলিফার আনুগত্য করবো না। রাসুলপত্নী হজরত আয়েশা রা.-এর মতও এটা ছিল যে, হজরত ওসমান রা.-এর হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়া হোক। হজরত আলি রা. এ কথা জানতে পেরে তিনিও এটা মত দিলেন যে, হজরত ওসমান রা.-এর হত্যাকারীদের সাজা হওয়া উচিত।

হজরত আলী রা. হজরত আয়েশা রা.-এর সঙ্গে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করেন; বসরায় উভয়ের গ্রুপের মধ্যে আলোচনাও শুরু হয়। হজরত আলী ও আয়েশা রা.-এর সমর্থকেরা যখন সমঝোতার কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে যান তখন মুনাফিকরা বিচলিত হয়ে পড়ে। মুনাফিকদের সরদার ছিল আব্দুল্লাহ বিন সাবা। ওই লোক প্রথমে ছিল ইহুদি, পরে ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু মুসলমান হওয়ার পর সে মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে লিপ্ত থাকে। আব্দুল্লাহ বিন সাবা যখন জানতে পারলো মুসলমানদের দুই পক্ষ পরস্পরে লড়াইয়ের পরিবর্তে সমঝোতায় পৌঁছে যাচ্ছে তখন সে একটি চক্রান্তের ফাঁদ তৈরি করলো। এক রাতে তার কিছু লোক আলি রা.-এর পক্ষে অবস্থান নিল আর কিছু লোক অবস্থান নিল আয়েশা রা.-এর পক্ষে। তারা পরস্পরের ওপর তীর মেরে লড়াইকে উস্কে দিল।

রাতের অন্ধকারে মুনাফিকদের এই চক্রান্ত সফল হলো। মুসলমানদের দুই পক্ষ পরস্পরে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে লিপ্ত হলো। হজরত আলী রা. এই লড়াই এড়ানোর অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি। কারণ হজরত আয়েশা রা.কে একটি উটের ওপর আরোহন করিয়ে যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। আলি রা. যখন দেখলেন উভয় দিকে সাহাবারা শহিদ হচ্ছেন তখন তিনি আয়েশা রা.-এর উটের ওপর হামলা করার নির্দেশ দিলেন। আঘাত পেয়ে উট মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পরে আয়েশা রা.কে অত্যন্ত সম্মান-সম্ভ্রমের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। এভাবে যুদ্ধ থেমে যায়। যুদ্ধের পর হজরত আলি রা. সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন সবার জানাজা তিনি নিজে পড়ান। আলি রা. তিনদিন পর্যন্ত বসরা’র বাইরে অবস্থান করেন। তিনদিন পর তিনি শহরে আসেন এবং হজরত আয়েশা রা.-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আলি রা. তার অনুসারীদের নির্দেশ দিলেন, উম্মুল মুমিনিন (মুমিনদের মা) হজরত আয়েশা রা.-এর সম্মানে যেন কোনো ত্রুটি না হয়। ফিরে যাওয়ার সময় তিনি জানতে পারলেন কুফাবাসী দুই লোক আয়েশা রা.-এর সঙ্গে বেয়াদবিমূলক আচরণ করেছে। তখন আলি রা. তাদের ডেকে বেত্রাঘাতের শাস্তি দেন।

হজরত আলি রা.-এর খেলাফতকালে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। মুনাফিকরা একদিকে হজরত ওসমান রা.-এর হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করতো অন্যদিকে হজরত আলি রা. যেন হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার মতো শক্তি অর্জন করতে না পারে সে চেষ্টাও অব্যাহত রাখতো। এভাবেই হজরত আলি ও মুয়াবিয়া রা.-এর অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। অপর আরেকটি গ্রুপ সৃষ্টি হয় যারা হজরত আলি, আমিরে মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আস রা.কে ঝগড়া-ফাসাদের মূল হোতা সাব্যস্ত করে তাদের হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ওই গ্রুপটি এক পর্যায়ে হজরত আমিরে মুয়াবিয়া রা.-এর ওপর হামলা করে বসে। তবে সে হামলা সফল হয়নি। আমর ইবনুল আস রা. এজন্য বেঁচে যান যে, তিনি অসুস্থতার কারণে মসজিদে আসেননি। কিন্তু আলি রা.-এর বিরুদ্ধে চক্রান্ত সফল হয় এবং তাকে শহিদ করে দেয়া হয়।

হয়ত কোনো কোনো ইতিহাসবিদ এসব ঘটনা সত্য বলে মানবেন না, কিন্তু আমি নিছক ড. তোয়াহা হোসাইনের বিশ্লেষণ বর্ণনা করলাম। এই বিশ্লেষণে দেখা যায়, মুনাফিকরা চক্রান্ত করে প্রথমে হজরত আলি রা. এবং হজরত আয়েশা রা.-এর মধ্যে যুদ্ধ বাধায়। পরে হজরত আলি ও আমিরে মুয়াবিয়া রা.-এর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে। পরে আমর ইবনুল আস রা.-এর সঙ্গে তাদের দুজনকেও হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করে।

আমি ঐতিহাসিক ওই ঘটনাগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়েছি। আজও কিছু মুসলমান নামধারী মুনাফিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। তারা মুসলমানদের ওপর কুফুরির ফতোয়া আরোপ করে মুসলমানদেরই হত্যা করাচ্ছে। যখনই মুসলমানদের বিরোধপূর্ণ বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সমঝোতার ব্যাপারে আলোচনার চেষ্টা চলে তখনই আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা’র গোষ্ঠী এমন কোনো ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাতে মুসলমানরা আলোচনা ছেড়ে ফের লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হয়।

আমাদেরকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। জঙ্গে জামাল ও সিফফিনের পরে সংঘটিত হয়েছিল কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা। সেখানে মুসলমানরাই মুসলমানদের হত্যা করেছিল। এসব ঘটনা কেন ঘটেছিল? এ ব্যাপারে মুসলমানদের ভাবতে হবে। ওই মুনাফিকদের চিহ্নিত করতে হবে যারা মুসলমানদের পরস্পরে ঝগড়া-লড়াই বাধায়। মদিনার সনদ থেকে শিক্ষা নিন, মুসলমানদের মধ্যে ফাসাদ বিস্তারকারীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। কাফেরদের খুশি করার জন্য মুসলমানদের রক্ত বইয়ে দেয়া কোনোক্রমেই বৈধ নয়। আসুন, এ যুগের আব্দুল্লাহ বিন সাবা’দের চিনে রাখি। মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হলে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন হতে বাধ্য।

[পাকিস্তানের দৈনিক জং পত্রিকা থেকে অনূদিত]

Related posts

*

*

Top