চলে গেলেন কুরআনের কোকিল

জহির উদ্দিন বাবর
Qariobaidullah_zahirbabor1কুরআনের সুরে তিনি পুরো জাতিকে মোহিত করতেন। খ্যাতি পেয়েছিলেন ‘কুরআনের কোকিল’ নামে। রেডিও-টিভিতে তাঁর আজানের সুমধুর ধ্বনি শুনেননি এমন মানুষ খুব কমই আছে। তাঁর মুখে কুরআনে কারিমের অমীয় তেলাওয়াত ছুঁয়ে যেতো প্রতিটি মানুষের অন্তর। দেশের হাজার হাজার কারী’র মধ্যে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সবাই একডাকে তাঁকে চিনতেন। সবমহলে ছিল তাঁর স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছে তিনি ছিলেন অনন্য শ্রদ্ধার পাত্র। কুরআনের এই খাদেম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশের জন্য বয়ে এনেছেন বিপুল সম্মান। সেই কারী মাওলানা উবায়দুল্লাহ রহ. চলে গেছেন না ফেরার দেশে। দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভুগে গত ২০ ডিসেম্বর ৭৩ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমিয়েছেন জান্নাতের দেশে।

বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত যে আজানের সুমধুর ধ্বনিটি আমাদের ধমনিতে বাজে সেটি কারী উবায়দুল্লাহ রহ.-এর। তাঁর জাদুকরী তেলাওয়াত বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে এক সময় নিয়মিত প্রচার হতো। পবিত্র রমজানের ইফতারের আগে শোনা যেতো তাঁর কোকিল কণ্ঠের তেলাওয়াত। তিনি তেলাওয়াত করেছে পাকিস্তান টেলিভিশনে। বাংলাদেশ টেলিভিশন উদ্বোধন হয় তাঁর কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে। জাতীয় সংসদের সেই উদ্বোধনী অধিবেশন থেকে তিনি নিয়মিত তেলাওয়াত করতেন। নবম সংসদ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল তাঁর তেলাওয়াত। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, নিউমার্কেট, হোটেল শেরাটনসহ জাতীয় অসংখ্য স্থাপনার উদ্বোধন হয়েছে কারী উবায়দুল্লাহর তেলাওয়াতের মাধ্যমে। তিনি সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, লিবিয়া, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্তত ২০-২৫টি দেশে আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় বারবার প্রথম স্থান অর্জন করে বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছেন বিরল মর্যাদা। সৌদি বাদশাহ ফয়সাল ও খালেদ দুইবার তাঁকে কুরআনের শিল্পী বা কারী হিসেবে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করেন।

কারী উবায়দুল্লাহ রহ. ২০০০ সালে প্রথম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এর ছয় বছর পর ২০০৬ সালে ঢাকার বাইরে একটি ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ার সময় ব্রেন স্ট্রোকের শিকার হন। তখন থেকেই তিনি চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলেন। দুই বছর পর তিনি আবারও ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে তাঁকে আর জনসম্মখে দেয়া যায়নি। রাজধানীর উপকণ্ঠে কামরাঙ্গীরের বাসায় নীরবে-নিভৃতে কাটিয়েছেন জীবনের সময়টুকু।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কোদালা ইউনিয়নে ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করে মাওলানা কারী উবায়দুল্লাহ রহ.। বিশিষ্ট আলেম আল্লামা শাহ মেহেরুজ্জামান ইসলামাবাদী (রহ.) ছিলেন তাঁর বাবা। প্রাথমিক পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ স্তরের পড়াশোনার জন্য চলে আসেন রাজধানীতে। ভর্তি হন লালবাগ জামিয়ায়। সেখানে মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.), শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.)-এর মতো মহান আলেমদের কাছে তিনি শিক্ষালাভ করেন। ১৯৬২ সালে লালবাগ মাদরাসা থেকে তাকমিল বা দাওরায়ে হাদিস পাস করেন। এরপর লালবাগ মাদরাসায়ই শিক্ষকতা শুরু করেন।
কারী উবায়দুল্লাহ রহ. মাত্র ১৮ বছর বয়সে নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত রেডিও পাকিস্তানে প্রথম কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করেন। ১৯৬৫ সালে শুরু হওয়া পাকিস্তান টেলিভিশনে শুরু থেকেই তিনি মধুর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তাঁর আজানও তাতে প্রচার হতো। ১৯৬২ সাল থেকে তিনি চকবাজার শাহী মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। চকবাজারসহ পুরান ঢাকার সর্বমহলে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। এছাড় সারা দেশের আলেম-ওলামার কাছে একজন বুযুর্গ হিসেবেও খ্যাতি ছিল তাঁর।

Qariobaidullah_zahirbabor2কারী উবায়দুল্লাহ রহ.-এর মধুর তেলাওয়াত বড় বড় ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাঁর একজন ভক্ত। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই তাঁর পেছনে জুমা পড়তে ছুটে আসতেন চকবাজারে। চকবাজার শাহী মসজিদের প্রবীণ মুসল্লিরা জানান, জুমার নামাজের পর বঙ্গবন্ধু কারী উবায়দুল্লাহ রহ.-এর সঙ্গে কোলাকুলি করতেন। তাঁকে বিশেষ হাদিয়াও দিতেন। বিভিন্ন উপলক্ষে নিজের বাসায়ও ডাকতেন কীর্তিমান এই আলেমকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও ছিলেন কারী উবায়দুল্লাহ রহ.-এর একজন ভক্ত। এমনকি তাঁর কাছে কুরআন পড়া শিখেছেন। প্রেসিডেন্ট থাকার সময় জিয়াউর রহমান প্রায়ই কারী উবায়দুল্লাহ রহ.-এর কুরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য তাকে বঙ্গভবনে ডেকে নিতেন।

জাতি হিসেবে আমরা বরাবরই অকৃতজ্ঞ। গুণীজনের যথার্থ কদর আমরা করি না। ব্যত্যয় ঘটেনি মাওলানা কারী উবায়দুল্লাহ রহ.-এর ক্ষেত্রেও। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার তাঁকে থাকার জন্য একটি বাড়ি বরাদ্দ দেয়। চকবাজার মডেল থানার চাঁদনীঘাট এলাকার গৌরসুন্দর রায় লেনের ৩৩/৩৭ নম্বর বাড়ির সাড়ে আট কাঠার মধ্যে চার কাঠা জমির বন্দোবস্ত দেয়া হয়। এই বাড়িতেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকতেন তিনি। বিভিন্ন সরকারের সময় বরাদ্দ পাওয়া বাড়িটি তাঁর নামে সাব-কবলা দলিল করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। এই সুযোগে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গেজেটভুক্ত বাড়িটি মামলা ও জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে নেয় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। পরে কামরাঙ্গীরচরের নিজামবাগ এলাকার মাতবর বাজারে স্ত্রীর নামে কেনা জমিতে শাশুড়ির নামে প্রতিষ্ঠিত আক্তার বানু নুরানি মাদরাসার ভবনেই শেষ আশ্রয় নেন তিনি। শেষ বয়সে অনেকটা কষ্টের দিন কাটান তিনি। কিন্তু ছিল না তাঁর পাশে দাঁড়ানোর সরকারি কোনো উদ্যোগ। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা টুকটাক হলেও সেটাও ছিল খুবই সামান্য। এভাবে অবহেলা-অনাদরে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যায় জাতির এই মূল্যবান সম্পদ।

*

*

Top