পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের নির্বাচন সম্পন্ন হলো। অভাবনীয় সাফল্যের সঙ্গে ইতিহাস গড়ে ক্ষমতায় আসছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। ৮১ কোটি ভোটারের এই দেশে ৫৪৩ আসনের পার্লামেন্টে মোট ২৮২টি আসনে জয়ী হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় এখন তারা জোটের শরিক দলগুলোর সমর্থন ছাড়াই সরকার গঠন করতে পারবে। নরেন্দ্র মোদিই হচ্ছেন ভারতের ১৪তম প্রধানমন্ত্রী। সব ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২১ মে তিনিই বসবেন দিল্লির মসনদে।
অন্যদিকে গত ১০ বছর ধরে ক্ষমতাসীন থাকা কংগ্রেস এবারের নির্বাচনে তাদের ইতিহাসের সবচাইতে খারাপ ফল করেছে। তারা মাত্র ৪৪টি আসনে জয়ী হয়েছে। ফলে ভারতের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী দলটি প্রধান বিরোধীদলীয় মর্যাদাও পাবে না। দক্ষিণ ভারতের তামিল জনগোষ্ঠীর জনপ্রিয় দল জয়ললিতার নেতৃত্বাধীন এআইডিএমকে ৩৭টি আসন পেয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ আসন পেয়েছে লোকসভায়। এরপর আছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস (৩৪টি) এবং ওড়িশার বিজু জনতা দল (২০টি)। এ ছাড়া শিবসেনা পেয়েছে ১৮টি এবং তেলেগু দেশম ১৬টি আসন।
বিজেপির এই ঐতিহাসিক বিজয়কে হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদির কারিশমা বলে মনে করা হচ্ছে। ‘মোদি-ঝড়’ এখন কাঁপাচ্ছে পুরো ভারতকে। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় মোদির ইন্ধন আছে বলে প্রমাণ থাকলেও নির্বাচনে হিন্দুপ্রধান দেশটিতে এই ইস্যু পাত্তাই পায়নি। এমনকি দিল্লি শাহী মসজিদের ইমাম সৈয়দ আহমদ বুখারি কংগ্রেসকে ভোট দিতে প্রকাশ্যে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানালেও তা তেমন কাজে আসেনি। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উত্তর প্রদেশ, বিহারসহ মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতেও বিজেপি অভাবনীয় ভালো ফল করেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সব ভয় উপেক্ষা করে মুসলমানরাও মোদিকেই বেছে নিয়েছেন নেতা হিসেবে। মুসলিম ভোটব্যাংকে সুবিধা পাওয়া কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থে তেমন কিছুই না করায় তারা দলটির প্রতি ক্ষিপ্ত ছিল। এজন্য সুযোগ বুঝে এবার কংগ্রেসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন মুসলিম সম্প্রদায়।
বিজেপি বা মোদি কারিশমায় এই অভূতপূর্ব ফল হয়েছে-এটা অনেকেই মানতে নারাজ। কংগ্রেসের সীমাহীন ব্যর্থতা বিজেপিকে সুবিধা এনে দিয়েছে বলে মনে করেন তারা। দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস দেশের উন্নয়নে তেমন কিছুই করতে পারেনি। প্রথম দফা পাঁচ বছর কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হলেও দ্বিতীয় দফায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে শুধু দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির পাল্লাই ভারী হয়েছে। মনমোহন সরকারের শীর্ষ পর্যায়েও দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস এসবের কোনো প্রতিকারই করতে পারেনি। এজন্য নির্বাচনে সোনিয়া-রাহুল বাদে শীর্ষ নেতৃত্বের বেশির ভাগই লজ্জাজনকভাবে হেরেছে। অন্যদিকে মোদি ভারতবাসীর সামনে স্বপ্নের ফানুস ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। রাজনীতি-অর্থনীতি পাল্টে দেয়ার স্লোগান নিয়ে হিন্দুত্ববাদী এই নেতা সারা ভারত চষে বেড়িয়েছেন। উন্নয়নে ‘গুজরাট মডেল’ দেখিয়ে তিনি সবাইকে বিমোহিত করেছেন। এর বিপরীতে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী রাহুল বয়সে তরুণ হওয়ায় মোদির সঙ্গে কৌশলে কূলিয়ে উঠতে পারেননি। তাছাড়া দলের অবশ্যম্ভাবী ভরাডুবি ঠেকাতে তার কোনো কৌশলই কাজে আসেনি। এমনকি তার বোন প্রিয়াঙ্কার ময়দানে ছুটে আসা এবং মা-ভাই তথা কংগ্রেসের জন্য আপ্রাণ চেষ্টাও বিফলে গেছে।
দুই.
ভারতের নির্বাচনের ধাক্কা বাইরের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেগেছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো এবং বিশ্লেষকেরা এই নির্বাচনটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এর বিশেষ তাৎপর্য হলো, বাংলাদেশের বিগত একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ভারতের ‘ওপেন সিক্রেট’ হস্তক্ষেপে। কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগ এবং বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এজন্য মনমোহন সরকার অনেক ক্ষেত্রে কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে আওয়ামী লীগকে একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। এতে স্বভাবতই বিএনপি কংগ্রেস সরকারের প্রতি কিছুটা ক্ষুব্ধ। এজন্য ভারতের লোকসভা নির্বাচনকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম এই দলটি। ‘বিজেপি ক্ষমতায় আসছে’ এমন আভাস পাওয়ার পর থেকেই বিএনপি ভেতরে ভেতরে দারুণ উচ্ছ্বসিত। দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিতে মোটাদাগে পরিবর্তন না এলেও কংগ্রেসের মতো অন্ধভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেবে না। কারণ, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিশেষ সম্পর্ককে বিজেপি কখনও ভালোভাবে নেয়নি।
এজন্য বিজেপির ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত হওয়ার পর সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বাস দেখা গেছে বিএনপি শিবিরে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এমন আভাস পাওয়ার পর আর দেরি না করে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। বিজেপি নিশ্চিত করেছে, খালেদা জিয়ার আগে মোদিকে কেউ শুভেচ্ছা জানাতে পারেনি। এতেই অনুমান করা যায় বিএনপি কতটা উচ্ছ্বসিত মোদি ক্ষমতায় আসায়।
তবে প্রকাশ্যে না হলেও মোদি ক্ষমতায় আসায় ভেতরে ভেতরে হতাশ আওয়ামী লীগ শিবির। খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মোদিকে। মোদির মনোযোগ আকর্ষণে শেখ হাসিনাও কসরত কম করছেন না। আওয়ামী লীগ নেতারা জোর গলায় বলার চেষ্টা করছেন, মোদি ক্ষমতায় আসায় তারা বিচলিত না। তবে ভেতরের খবর হলো, কংগ্রেসের বিশাল ভরাডুবি আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। তারা হিসাব কষছেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হলে তাদেরও এমন করুণ পরিণতি হতে পারে।
তিন.
ভারতের নির্বাচন এবং নতুন সরকার নিয়ে আমাদের দেশের বড় দুটি দল নিজেদের মতো করে হিসাব-নিকাশ করবে-এটাই স্বাভাবিক। তবে সাধারণ মানুষের বিশ্লেষণ হলো, সদ্য অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন আমাদের দেশের রাজনীতির জন্য অনেক বড় শিক্ষা হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের আখের গোছানোর চিন্তা এবং চাপাবাজি থেকে বেরিয়ে এসে এখান থেকে ভালো ভালো জিনিসগুলো গ্রহণ করতে পারে। সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক এই দেশের নির্বাচন বেশ কয়েক ধাপে প্রায় মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বড় ধরনের কোনো অভিযোগ-বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছিল শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আমাদের পাঁচ দফা উপজেলা নির্বাচনে যে সহিংসতা, কারচুপি, দখলদারিত্বের নজিরবিহীন দৃশ্য আমরা দেখতে পেয়েছি এর ছিটোফোঁটাও ছিল না লোকসভা নির্বাচনে। নিজেরা ক্ষমতায় থেকে ভরাডুবির আভাস পাওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রক্রিয়ায় অবৈধ হস্তক্ষেপ করেনি কংগ্রেস। আমাদের দেশের কোনো দলের ক্ষেত্রে কি এটা ভাবা যায়! বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার যে নির্লজ্জ ও ন্যাক্কারজনক মহড়া আমরা দেখেছি-তাতে এমন সভ্য আচরণ কোনো দল থেকেই আশা করা যায় না।
ভারতের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সে দেশের নির্বাচন কমিশনের। সাংবিধানিকভাবে তারা নির্বাচন কমিশনকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখেছে। নির্বাচন চলাকালে কমিশন যেকোনো প্রার্থীকে তলব, সতর্ক ও হুঁশিয়ারি দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মোদি ও রাহুলকে পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কঠোর ভাষায় সতর্ক করেছে। ৮১ কোটি ভোটারের এই নির্বাচনে কমিশনের বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না বললেই চলে। অথচ এর বিপরীতে আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের কথা ভাবলে রীতিমতো লজ্জিত হতে হয়। এ পর্যন্ত কোনো কমিশনই পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে বাইরে বের হতে পারেনি। আগে ‘আজিজ-মার্কা’ কমিশন বলে মশকরা করতেন আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু এবার ‘রকিব-মার্কা’ কমিশন অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। একটি নির্বাচন কমিশন যে এত ব্যক্তিত্বহীন, বিশেষ কোনো দলের পা-ছাটা ও তাঁবেদার হতে পারে তা রকিবউদ্দীনের কমিশন না দেখলে বিশ্বাস করা যেতো না। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদের নির্বাচন কমিশন বেশি শক্তিশালী। নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার হাস্যকর নজিরও আমাদের বর্তমান নির্বাচন কমিশন স্থাপন করেছে। সুতরাং তাদের কাছ থেকে একটি নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন আশা করার কোনো কারণ নেই।
ভারতের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি কেড়েছে রাজনৈতিক উদারতা। মোদি প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন এমন আভাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মোদিকে ফোনে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। কিছুক্ষণের মধ্যে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে পরাজয় মেনে নিয়ে মোদিকে অভিনন্দন জানানো হয়। এত বিরোধপূর্ণ দুটি দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিশাল এই দেশটিতে কোথাও নির্বাচনপরবর্তী কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলেও খবর পাওয়া যায়নি। আমাদের দেশের বাস্তবতায় কি এটা ভাবা যায়? আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে কি হেরে যাওয়া দল বিজয়ীদের শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানিয়েছেন? হেরে যাওয়ার পরপরই তো খোঁজা হয় ‘সুক্ষ্ম’ আর ‘স্থুল’ কারচুপির কাহিনী। আর নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতার মাত্রা যে কত ভয়াবহ হতে পারে তা আমরা বিগত দিনের নির্বাচনগুলোতে দেখেছি।
নির্বাচনের ফলাফলে নিজেদের ভরাডুবির আভাস পেয়েই কংগ্রেস-প্রধান সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে পরাজয়ের সম্পূর্ণ দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এমনকি ঐতিহ্যবাহী দলটির দুই কাণ্ডারী মা-ছেলে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে পারেন বলেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। একবারের জন্যও তারা বলেননি, আমরা ঠিক করেছি, জোর করে আমাদেরকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু তারাই নন, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব সবাই দলের ব্যর্থতার দায় নিজেদের কাঁধে নিয়েছেন। ইতিমধ্যে এই বিপর্যয়ের দায় নিয়ে ইস্তফা দিয়েছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ও ওই দলের নেতা নীতীশ কুমার। এই তালিকায় আরো অনেকেই যুক্ত হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে এই কালচারটি আজও গড়ে ওঠেনি। আমাদের নেতারা সাফল্যের ভাগ নিতে প্রস্তুত, কিন্তু ব্যর্থতার দায় নিতে রাজি নন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির যে ব্যর্থতা ছিল তা তো এখন স্বীকৃত। কিন্তু আজ পর্যন্ত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে কেউ কি এর দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন? ‘অমুক’ না ‘তমুক’ দায়ী এসব করেই তো দলটি পাঁচ মাস কাটিয়ে দিয়েছে। এখনো ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো আভাস চোখে পড়ে না। সুতরাং ভারতের নির্বাচন আমাদেরকে মোটাদাগে এই শিক্ষাগুলো গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মানলে ভারতের নির্বাচন হতে পারে আমাদের দেশের জন্য মডেল।