জহির উদ্দিন বাবর
‘৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কালেমা জানেন না’, ‘৬ জেলার প্রশাসক ওজুর ফরজ বলতে পারেন না’ ‘১০ মন্ত্রী জানেন না কোন ওয়াক্তে কত রাকাত নামাজ’ ‘৫ বুদ্ধিজীবী ৪০ বছর ধরে নাপাক’ ‘৫০ এমপি জানেন না জানাজার নিয়ম’ শিরোনামগুলো কাল্পনিক। তবে কোনোদিন মিডিয়ায় শিরোনামগুলো হাইলাইটস করে প্রকাশ হতেও পারে। অগ্রজ লেখক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদের কাছ থেকে এই আইডিয়াগুলো ধার করা। আলেম-ওলামা ও মাদরাসাপড়ুয়াদের নিয়ে মিডিয়ায় যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো রিপোর্ট হয় তখন এই কথাগুলো খুব মনে পড়ে। অপেক্ষার প্রহর গুণি, কবে এসব শিরোনামের পত্রিকাগুলো বাজারে আসবে আর কথিত আধুনিক শিক্ষিতদের মুখোশ জনসম্মুখে উন্মুচিত হয়ে যাবে।
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধান মুন্নি সাহা দেশের এক প্রান্ত পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় কয়েকটি মাদরাসা নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন করেছেন। সেখানে মক্তবে পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে ডান্ডা ধরে জানতে চেয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী কে, জাতীয় সঙ্গীত পড়া হয় কি না, শপথবাক্য পাঠ করে কি না ইত্যাদি। রিপোর্টের উদ্দেশ্য হলো মাদরাসাগুলোতে ‘কুশিক্ষা’ দেয়া হচ্ছে এবং ‘জঙ্গিবাদের’ উৎপত্তি এখান থেকে এটা বোঝানো। মুন্নি সাহাদের এই অপচেষ্টা অনেক দিন ধরেই অব্যাহত আছে। আলোচিত-সমালোচিত এই নারী সাংবাদিক নানা সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভিন্ন টেলিভিশনে আলেম-ওলামা ও মাদরাসাপড়ুয়ার চরিত্র হনন করেছেন। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি নিজ অঙ্গনেও কম সমালোচিত নন। অনেক সাংবাদিককে তার নাম নিয়ে প্রায়ই টিপ্পনি কাটতে দেখা যায়। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে হেনস্থা হওয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে অসাংবাদিকসুলভ প্রশ্ন করে নাজেহাল হওয়ার রেকর্ডও তার রয়েছে। সাংবাদিকতা বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এই সাংবাদিকের অসাংবাদিকসুলভ আচরণ সবার জানা।
কওমি মাদরাসা নিয়ে মুন্নি সাহা রিপোর্ট করবেন ভালো কথা, এজন্য তিনি সেই তেঁতুলিয়ার অঁজপাড়াগায়ের মাদরাসাগুলো বেছে নিলেন কেন? রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোর মাদরাসা নিয়েও তো রিপোর্ট করতে পারতেন। এতেই বোঝা যায় তার উদ্দেশ্য খারাপ। গ্রামের সহজ-সরল শিশুদের বোকা বানিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্ট করাই তার টার্গেট। যারা কোনো দিন টেলিভিশনের মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ায়নি তারা অনেক জানা কথাও ভুলে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। আর সেই বক্তব্যগুলোর ওপর ভিত্তি করে যখন প্রায় পাঁচ হাজার মাদরাসার বিচার করা হয় তখন সেই বিচার কতটা গ্রহণযোগ্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুদিন আগে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়াদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছিল একটি বেসরকারি চ্যানেল। সেখানে ফুটে উঠেছে দেশের কথিত আধুনিক শিক্ষার ভয়াবহ চিত্র। যদিও ওই রিপোর্ট নিয়েও আছে অনেকের প্রশ্ন। সেই রিপোর্ট দিয়েও সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার তুলনা করা সমীচীন হবে না।
কওমি মাদরাসাগুলোতে জাতীয় সঙ্গীত পাঠ করা হয় না এটা তো কোনো গোপনীয় বিষয় না। সরকারি কোনো স্বীকৃতি বা অনুদান না থাকায় সেখানে জাতীয় সঙ্গীত পাঠ করার বাধ্যবাধকতাও কোনো দিন আরোপ করা হয়নি। এখন বেশির ভাগ মাদরাসায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সরকারি স্বীকৃতি পেলে কওমি মাদরাসাগুলো প্রয়োজনে জাতীয় সঙ্গীতও গাইবে। প্রয়োজন মতো বাংলা-ইংরেজি কওমি মাদরাসাগুলোতে পড়ানো হয়। ইংরেজি খুব ভালো না পারলেও বাংলায় কওমি শিক্ষার্থীরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। পরবর্তী জীবনে বাংলা-ইংরেজির প্রয়োজনটা জোরালোভাবে দেখা দেয় না বলেই এ বিষয়গুলো ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তবে এগুলোর প্রতি যে গুরুত্ব দেয়া দরকার সেই বোধ ও তাগিদ তো কওমি মাদরাসার ভেতরেই জাগ্রত হচ্ছে। সেটার সবক মুন্নি সাহাদের কাছ থেকে নিতে হবে কেন!
সুবিধাবঞ্চিত এতিম-গরিবদের শিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে কওমি মাদরাসাগুলো। আজকের সমাজে যে শিক্ষার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই নৈতিক শিক্ষা শেখানো হচ্ছে কওমি মাদরাসায়। এখানে পড়ে কোনো ছাত্র মোটরসাইকেলের জন্য বাবাকে পুড়িয়ে হত্যা করে না; এখানকার কোনো শিক্ষার্থী নেশায় বুদ হয়ে ঐশীর মতো বাবা-মাকে বন্ধুদের নিয়ে হত্যা করে না। শান্ত-নিবিড় কওমি মাদরাসাগুলো রাষ্ট্রীয় কোনো সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নিজেদের মতো করে কোনোরকম চলছে। আর সেই শিক্ষাব্যবস্থার ওপরই শকুনদের যত নজর। দেশের ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করে না, সেখানে নজর পড়ে না মুন্নি সাহাদের। জনগণের টাকায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও সন্ত্রাসী, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ ও চরিত্রহীন লোকেরা বের হচ্ছে। তাদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ে বড়লোকের সন্তানেরা যখন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে সেটা নিয়েও তারা ভাবিত নয়। যত দোষ এই কওমি মাদরাসাগুলোর। নৈতিকতা বিবর্জিত ও অন্তঃসারশূন্য কথিত প্রগতিশীল যে জাতি মুন্নি সাহারা দেখতে চান সেখানে এই মাদরাসাগুলোই প্রধান প্রতিবন্ধক। তাই এগুলোর যাত্রা বাধাগ্রস্ত করা কিংবা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা অতীতেও ছিল, আগামীতেও চলবে।
দুই.
ফিরে আসি অগ্রজ শরীফ মুহাম্মদের কথায়। তাঁর বক্তব্য হলো, আমাদের হাতে মিডিয়া থাকলে তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ উন্মোচন করা যেতো। যারা মসজিদ, মাদরাসা, আলেম-ওলামা এবং দ্বীনদারদের সহ্য করতে পারে না, আবার নিজেরা মুসলমান বলে দাবি করে তাদেরকে সমাজের সামনে উলঙ্গ করা যেতো খুব সহজেই। দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসিদের কাছে গিয়ে বলা হতো, গোসলের ফরজ কয়টি? তাদের অবস্থা দেখে বুঝতে বাকি নেই ঠিক করে গোসলের ফরজগুলো কেউই বলতে পারবেন না। পরদিন পত্রিকার বড় শিরোনাম হতো ‘৪০ বছর ধরে নাপাক দেশের ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’। এভাবে নানা শ্রেণির ইসলামবিদ্বেষী লোকদের ধরে ধরে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়া যেতো।
কিন্তু আফসোসের বিষয় একটাই। সবারই সেটা জানা। মিডিয়া আজ আমাদের হাতে নেই। ‘বড় লোকের বাড়ির কুকুর’ মিডিয়া আজ কারা নিয়ন্ত্রণ করছে সেটা কারোই জানার বাকি নেই। ইসলামপন্থিরা বছরের পর বছর মিডিয়া আগ্রাসনের একতরফা শিকার হচ্ছেন, কিন্তু নিজেরা শক্তিশালী কোনো মিডিয়ার হর্তাকর্তা হওয়ার মতো ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ তাদের নেই। মিডিয়ার ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান শতমাইল দূরে কিন্তু অপরের মালিকানধীন মিডিয়ায় কেন তাদের সম্পর্কে বিরূপ কিছু প্রকাশ করলো তা নিয়ে আক্ষেপের কোনো শেষ নেই। এভাবে সারা জীবন আক্ষেপ করেও কোনো লাভ নেই।
প্রত্যেকেই একটি টার্গেট নিয়ে মিডিয়া করে। সত্য, সুন্দর, বস্তুনিষ্ঠতা এসব কিতাবি কথাবার্তার খাওয়া এখনকার মিডিয়া জগতে নেই। অন্যের অর্থে প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ায় আনুকূল্য পাওয়া কিংবা তাদের দংশন থেকে নিরাপদ থাকার অবাস্তব চিন্তা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। মুন্নি সাহাদের মতো সাংবাদিকরা ইসলামন্থিদের বিরূপভাবে উপস্থাপনের মিশন নিয়েই এই পেশায় এসেছেন। তারা তাদের পেশায় ও টার্গেটে অবিচল। তাদেরকে প্রতিহত করতে হলে কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হবে। কিন্তু ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই বিধিরাম সর্দার’ হয়ে বসে বসে আঙ্গুল চুষলে আজীবন কাঁটা খেয়েই যেতে হবে; প্রতিহত করা আর সম্ভব হবে না।