যাঁর কাছে ঋণী এদেশের আলেমসমাজ

01বিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে ভারত উপমহাদেশের গগনে প্রৌজ্জ্বল দ্বীপ্তি নিয়ে আবির্ভূত হন মহান সংস্কারক সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.। যিনি বহুমুখী জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আখলাক-চরিত্র, ইখলাস ও তাকওয়া দ্বারা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবায় যুগান্তকারী অবদান রেখে গেছেন। বাতিলের তুফান থেকে ইসলামী প্রদীপকে রক্ষা করেছেন। যুগের দুর্যোগ থেকে মুসলিম উম্মাহর কাফেলাকে হেফাজত করেছেন। তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের পরিচিতি পৃথিবীর আনাচে-কানাচে সমানভাবে পরিব্যপ্ত। সমগ্র বিশ্বে ‘শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর সংস্কারক হিসেবে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে ইতিবাচকভাবে ইসলামকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে তিনি অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করে গেছেন। বিশ শতকের সিংহভাগজুড়ে তাঁর কর্মক্ষেত্র ব্যাপৃত।
১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। সমগ্র পৃথিবী তখন মিলোনিয়ামের স্রোতে ভাসমান। একবিংশ শতাব্দীকে স্বাগত জানানোর জন্য সবাই ব্যস্ত। নতুন শতকের সূর্যোদয় হওয়ার পূর্বেই এই মহামনীষী পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তাঁর ইন্তেকালের সংবাদে সারা বিশ্বে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঝড় বয়ে যায়। সবাই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। সৌরবছরের শেষ দিনটি প্রতি বছরই তাঁর স্মৃতি ও বিশাল অবদানকে আমাদের সামনে তাজা করে দিয়ে যায়।
মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী সংক্ষেপে আলী মিয়াঁ ৬ মহররম, ১৩৩৩ হিজরী, ৫ ডিসেম্বর ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলী জেলাধীন ‘তাকিয়া কেলা’নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হাকীম মাওলানা আব্দুল হাই এবং মাতা খায়রুন্নেসা। উভয়ের বংশ পরিক্রমা রাসূল সা. এর দৌহিত্র হাসান  রা. এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা শাহ আহমদ শহীদ রহ. ছিলেন তাঁর পূর্ব পুরুষ। এজন্য ধমনীতে জিহাদি জযবা ছিল বহমান। নদভী রহ. প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তাঁর মাতার নিকট। অল্প বয়সেই তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ, তাজবীদ প্রভৃতি বিষয়ে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। লক্ষ্মৌ ইউনিভার্সিটিতে উলূমে শারকিয়্যাহ (প্রাচ্যবিদ্যা) বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ভারত উপমহাদেশের দুটি শ্রেষ্ঠ ইলমী মারকায দারুল উলূম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল ওলামা থেকে হাদীসের সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। দর্শনশাস্ত্রে তাঁর গভীর মনোযোগ ছিল। আরবী-উর্দূ ও ইংরেজি-তিন ভাষাতেই তাঁর দখল ছিল অসাধারণ। উন্নত ভাষাশৈলী, সাবলীল উপস্থাপনা, জ্বালাময়ী ভাষণ, উদার ও পরিমিত দৃষ্টিভঙ্গি, দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা এবং সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনার কারণে তিনি মানুষের মনের মুকুরে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। অসংখ্য সদগুণের সমাবেশ ঘটেছিল তার সুমহান চরিত্রে। তাঁর চিত্তের উদারতা ছিল আকাশসম। ইখলাস ও লিল্লাহিয়াতের নূরে জ্যোতির্ময় ছিল তাঁর প্রতিটি আমল ও কাজ। দারুল উলূম নদওয়াতুল ওলামার শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের নাযেম বা পরিচালক ছিলেন। একে কেন্দ্র করেই তার সুবিশাল কর্মপরিকল্পনা ও মিশন পরিচালিত হয়। এছাড়াও তিনি দামেস্ক ও মদিনা ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নদভী রহ. এর বিচরণ এতই ব্যাপৃত ছিল যে, তিনি যত বড় বড় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন, যার বিবরণ এই ক্ষুদ্র পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়। তিনি অক্সফোর্ড ইসলামিক একাডেমীর আজীবন সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, রাবেতা আদবে ইসলামী (আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থা), দ্বীনি তালিমী কাউন্সিল প্রভৃতির সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রাবেতা আলমে ইসলামী, মদীনা, দামেস্ক, কায়রো, জর্দান একাডেমী ও দারুল উলূম দেওবন্দ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের আজীবন সদস্য ছিলেন। ১৯৮১ সালে কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে তাকে সাহিত্যে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি  দেয়া হয়। এছাড়াও তিনি শাহ ফয়সাল অ্যাওয়ার্ড, ব্রুনাই ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক পুরস্কারে ভূষিত হন। এ সমস্ত পুরস্কারের সব অর্থই তিনি গরিব-দুঃখী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান করে দেন।
মুসলিম উম্মাহর প্রতি তাঁর ছিল গভীর দরদ। উম্মাহর অবক্ষয়ের সঠিক কারণ অনুসন্ধান, পশ্চিমাদের ইসলামবিরোধী অপতৎপরতা সম্পর্কে সতর্কীকরণ এবং মুসলমানদের পুনর্জাগরণের জন্য তাঁর গবেষণা ছিল বিরামহীন। বক্তৃতার যাদু ও লিখনির সম্মোহনী শক্তি দিয়ে তিনি আজীবন সত্যের সংগ্রাম করে গেছেন। মূলত তিনি তার এ দুটি অলৌকিক শক্তির বলেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এত পরিচিতি লাভ করেছিলেন। আরবী ভাষায় রচিত তার অমর গ্রন্থ ‘মা যা খাসিরাল আলামু বি ইনহিতাতিল মুসলিমীন’ (মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারাল?) সারা  দুনিয়ায় ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছে। বিশ্বের প্রায় ভাষাতেই এটি অনূদিত হয়েছে। মূলত এই দুটি গ্রন্থের দ্বারাই তিনি বিশ্ববাসীর নিকট সর্বপ্রথম পরিচিতি লাভ করেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখক সাহিত্যিকরা এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। খোদ আরবরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, একজন অনারব দ্বারা আরবী ভাষায় এ ধরনের গ্রন্থ লেখা কিভাবে সম্ভব। প্রায় চৌদ্দ বছর দৃষ্টিশক্তির ক্ষীণতার পরও তিনি পাঁচ শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রতিটি রচনাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
02ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত জনপদে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অবস্থান সুসংহত করার ক্ষেত্রে তার অবদান চিরস্মরণীয়। ভারত জাতীয়তাবাদে হিন্দু-মুসলিমের সৌহার্দমূলক অবস্থান কায়েম করার ক্ষেত্রে নদভী রহ. মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর দর্শন ছিল ইতিবাচক উপায়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে বুদ্ধিবৃত্তিক সকল ময়দানে বাধা-বিপত্তির মোকাবেলা করা। তাঁর ভাষায় ‘বর্তমান সময়ে ধারালো তলোয়ারের যত না প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন শাণিত কলমের। কারণ উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর যত না চলছে সশস্ত্র হামলা তার চেয়ে বেশি চলছে বুদ্ধি ও বিবেকের মামলা।’ মুসলিম উম্মাহর এই ক্রান্তিলগ্নে আজ তাঁর দর্শন সময়োপযোগী হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. দুইবার বাংলাদেশে সফর করেছেন, ১৯৮৪ সালে এবং ১৯৯৪ সালে। বাংলাদেশের প্রতিও তাঁর অতুলনীয় দরদ ও ভালবাসা ছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রতি আলেমসমাজের উদাসীনতা দেখে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি এ সম্পর্কে আলেমদেরকে সতর্ক করেছেন। তাঁর এসব বক্তৃতা ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে ‘প্রাচ্যের উপহার’ নামে সংকলিত হয়েছে। মূলত নদভী রহ.-এর উদ্বুদ্ধকরণের ফলেই এদেশের আলেমরা ব্যাপকভাবে কলম হাতে তুলে নেন। এজন্য এদেশের আলেমসমাজ তাঁর কাছে চিরঋণী। সাম্প্রতিক সময়ে এই মনীষীর অনেকগুলো বই বাংলায় অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশে তাঁর বেশ কিছু খলিফা ও ভক্ত-অনুরাগী রয়েছেন। নদভী রহ. এর মিশন বাস্তবায়নের জন্য তারা স্ব স্ব অবস্থান থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ‘সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এডুকেশন সেন্টার’নামে একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে ঢাকার মিরপুরস্থ মাদরাসা দারুর রাশাদে। তবে এই মহামনীষীর মিশনকে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করতে হলে আরও ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। সময়ের প্রয়োজন বিবেচনা করে তার মিশন বাস্তবায়ন করার জন্য সকলকে এগিয়ে আসা জরুরি।
আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.ছিলেন জীবন্ত সংস্কারক ও মুসলিম উম্মাহর অব্যাহত ও অনাগত প্রতিটি সমস্যার আশু সমাধানদাতা। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তাঁর মিশনের মূল লক্ষ্য। তার দেখানো পথে চললে আজও মুসলিম উম্মাহ ফিরে পেতে পারে হারানো ঐতিহ্য ও  সোনালী ভবিষ্যত।

Related posts

*

*

Top